মাদকের বিরুদ্ধে সরকার ও পরিবার- দু’জায়গা থেকেই কঠোর অবস্থান প্রয়োজন

829

॥ শাহ আলম বাদশা ॥
ঢাকা, ১৫ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : দেশে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মাদক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়, এদেশে মাদকাসক্তদের ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ ও ২০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। অর্থাৎ মোট মাদকাসক্তের পাঁচভাগের একভাগই নারী। অন্যদিকে জাতিসংঘের এক জরিপ-প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৬৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। সেই হিসেবে এদেশে ১৩ লাখের বেশি নারী কোনো না কোনো মাদকসেবন করছেন।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের ‘নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে’ চিকিৎসা নিতে আসা ৯৫ জন মাদকাসক্ত নারীর ওপর চালানো জরিপ থেকে জানা গেছে যে, চিকিৎসা নিতে আসা মাদকাসক্ত নারীদের মধ্যে ৫৬ ভাগই ইয়াবাসেবী।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি পরিবারের নিয়ামক শক্তিই হচ্ছেন একেকজন স্বাস্থ্যবান সুস্থ মা। তাদের যদি সুস্থ সমাজে ফেরানো না যায়, তবে জাতি দ্রুতই অসুস্থ হয়ে পড়বে। কাজেই মাদকবিরোধী অভিযানকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। শুধু আইন দিয়ে মাকাসক্তি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। লাগাতার ক্যাম্পেইন, কাউন্সেলিং ও ধর্মীয় চর্চাই পারে মাদকাসক্তদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে এবং মাদক পরিহারে উদ্বুদ্ধ করতে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, ১৯৯০ সালে দেশে মাদকাসক্ত ছিল মাত্র ৬ লাখ। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরের ব্যবধানে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা কমপক্ষে ৬৫ লাখ। কোনো-কোনো হিসেব মতে, ৮০ লাখ।
দেশে মাদকের সহজলভ্যতার মূলকারণ হচ্ছে ব্যাপক মাদকচাষ ও উৎপাদনকারী প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের মাদক-ব্যবসা ও পাচারের মূল রুট এই বাংলাদেশ। এছাড়াও প্রতিবেশী ভারত থেকেও মাদকের অবৈধ প্রবেশ ঘটছে।
বর্তমানে নারী মাদক সেবীদের ৪৩ শতাংশই ইয়াবা সেবী। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে ¯্রােতের মতো ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। ২০১২ সালে চীন-থাইল্যান্ডের ‘মেকংসেফ’ চুক্তির পর থাইল্যান্ডে ইয়াবা পাচার কঠিন হয়ে গেলে সেই অপরাধীরা বাংলাদেশকে টার্গেট করে।
কম্বোডিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাংবাদিক নাথান এথম্পসন মিয়ানমার ও বাংলাদেশে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেন, যা ২৪ জুলাই জাপানের নিকেই এশিয়ান রিভিউ সাময়িকীতে ‘বাংলাদেশে ইয়াবা সমস্যা’ শিরোনামে ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদনে সরকারি সূত্র ও বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ২০ লাখ ইয়াবা সেবন করা হয়ে থাকে।
মেথামফেটামিন ও ক্যাফেইনের সমন্বয়ে তৈরি ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন বাংলাদেশে শুরু হয় ২০০৬ সালের দিকে। এর আগে এক শ্রেণির তরুণ গাঁজা বা হেরোইনের নেশায়ই বুঁদ থাকতো। তাদের কাছে এখন ইয়াবাই বেশি প্রিয়। বর্তমানে একেকটি ইয়াবা ট্যাবলেট গুণগত মান ভেদে ৩০০ থেকে ৯০০ টাকা দামে বিক্রি হয়।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো.জামাল উদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের মাদক বিরোধী আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের ব্যবস্থা থাকলেও এর কিছু ত্রুটি এখনো রয়ে গেছে। প্রচলিত আইনের তফসিলে বেশ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই। এই আইনে মাদকের গডফাদার বা মাস্টার-মাইন্ডদেরকে সোপর্দ করার কোন ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, আমরা আইন সংশোধন করে, যারা মাদকের ব্যবসা করে এবং মাদক তৈরি করে তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য আইনানুগ বিধান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরো কঠোর ও যুগোপযোগী করে মাদক নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। সরকার এর আগে ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ব্যাপক পরিবর্তন করে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৭’ পাশ করে। নতুন আইনে ৭টি ধারা ও ২৮ টি সংজ্ঞা সংযোজিত করা হয়েছে। আইনে মাদকের অর্থ যোগানদাতা, পৃষ্ঠপোষক, মদতদাতা, সেবনকারী ও বহনকারীর অপরাধ ভেদে শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড ও ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
সরকার সারাদেশে মাদকচোরাচালান ও মাদকপাচার ঠেকাতে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রেখেছে। যার মাধ্যমে মাদকের বেচা-কেনা ও অনুপ্রবেশ অনেকাংশেই কমেছে। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে সীমান্তে ফেনসিডিলপাচারও অনেকটা কমেছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা ঠেকাতে মিয়ানমার সরকারের সাথে বৈঠক ও নাফ নদীতে মাছধরা বন্ধের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া মাদকাসক্তি রোধে মানসম্পন্ন মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্র, পরামর্শ কেন্দ্র ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণেও কার্যকরী ভূমিকা রাখছে সরকার।
মাদকাসক্তি রোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিকভাবে নতুন প্রজন্মকে মাদকসহ সকল অসুস্থ চিন্তা থেকে দূরে রাখার আন্দোলন তৈরি করা। মাদকের বিরুদ্ধে সরকার এবং পরিবার-দুই জায়গা থেকে কঠোর অবস্থান নেয়া উচিত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব হবে মাদকের সব ধরনের উৎস খুঁজে বের করে ধ্বংস করা। আর পরিবারের উচিত নিজেদের সন্তান বা পরিজনকে মাদকের কুফল সম্পর্কে জানানো। সামাজিক অবক্ষয়রোধে সৌহার্দ্যবৃদ্ধিও জরুরি। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠা এবং ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাবেও অনেকে বিপথগামী হচ্ছে। এসবের হাত থেকে সন্তানদের রক্ষা করতে পরিবারকেই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে।