করোনার প্রভাবে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় বেড়েছে বাল্যবিবাহ

1858

ঢাকা, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০ (বাসস) : বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত একটি শব্দ করোনাভাইরাস। এটি বিশ্ব অর্থনীতিকে যেমন ধ্বংস করেছে, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রেও ফেলেছে প্রভাব। যে প্রভাব থেকে বাদ পড়েনি বাংলাদেশও। কেবল অর্থনীতি নয় বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে অনেক বেশি। এর ফলে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশে বেড়েছে বাল্যবিবাহের হার।
মূলত দরিদ্র পরিবারের উপার্জন কমে যাওয়া, শিক্ষালয় বন্ধ থাকা ও কিছুটা নিরাপত্তার অভাব এর অন্যতম কারণ।
বাবা-মা অনেকটা নিরূপায় হয়েই অনেক সময় ইচ্ছের বিরুদ্ধে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন। দেশের উত্তরাঞ্চলে বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি। সম্প্রতি লালমনির হাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলায় রুবি আক্তার (ছদ্ম নাম) নামের এক কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন। করোনা মহামারিতে দরিদ্র পিতার আয় রোজগার বন্ধ হয়ে হয়ে গেলে পরিবারটি অভাবে পড়ে। পরিবারের খাবারের মুখ কমাতেই এ বাল্য বিবাহের আয়োজন। রুবির বাবা গোলাম কাদের জানান, পাত্রপক্ষকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। পাশের বাড়ির আরেক মেয়ে ১৪ বছর বয়সী কুলসুম। তার বাবাও যৌতুকের বিনিময়ে এই করোনার মধ্যেই বিয়ে ঠিক করেছেন। কুলসুম চেষ্টা করেও বিয়ে আটকাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ নম্বরে ফোন করে সহায়তা চাইলে স্থানীয় প্রশান দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে কুলসুমের বিবাহ বন্ধ করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের এই সময়ে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ প্রায় দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবার ও প্রতিবেশীরা বিষয়গুলো জেনেও এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কেবল মাত্র পরিবারের আর্থিক অনটনের কথা ভেবে অনেক পরিবার কিছুটা গোপনে, কোন আয়োজন ছাড়াই নীরবে কিশোরীদের বিয়ে দিয়ে সংসারের লোক সংখ্যা কমাতে চাইছে। যে কারণে বাল্য বিবাহ ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রশাসনের কড়া হস্তক্ষেপের কারণে কিছু বাল্যবিবাহ ঠেকানো গেলেও বেশির ভাগই ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্যা এবং কোভিড-১৯ মহামারী বাল্যবিবাহের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। এমনিতেই দেশের চরাঞ্চল, উপকূলীয় ও প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে বাল্যবিবাহের হার বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকা ও চরাঞ্চলের এর প্রভাব অনেক বেশি। গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর ও ভোলা জেলা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে। দরিদ্র পরিবারের দৈনিক উপার্জন কমে যাওয়া, স্কুল বন্ধ হওয়া, লেখাপড়া বন্ধ থাকায় পরিবারগুলো মেয়েকে বিয়ে দেয়াটাই নিরাপদ মনে করছে। এতে পরিবারের জনসংখ্যা বা খাবারের মুখ কমানো যাচ্ছে। অসচেতনতা, কন্যা সন্তানের ভরনপোষণ ও নিরাপত্তা দিতে না পারা, মহামারিতে কম খরচে ও অল্প যৌতুকে বিয়ে দিতে পারাটাও বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ মনে করছেন বিজ্ঞ জনেরা।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় চাইল্ড হেল্প লাইন ১০৯৮ সারা দেশে বিপদে পড়া শিশুদের সাহায্য করে থাকে। প্রতিটি উপজেলায় চাইল্ড হেল্পলাইনের মোবাইল টিম কাজ করছে। সংস্থার কর্মীরা ইউনিয়ন পর্যায়েও কাজ করছে।
করোনার কারণে দেশে বাল্যবিবাহ বেড়েছে মনে করছেন হেল্পলাইনের ব্যববস্থাপক চৌধুরি মো. মোহাইমেন।
তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের এপ্রিলে চাইল্ড হেল্পলাইনে বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ৪৫০টি ফোন কলে আসে। অথচ মার্চ মাসে এ সংখ্যা ছিল ৩২২। আগে যেখানে বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ১০০টি কল পেতাম মহামারির কারণে এখানে কমবেশি ১৮০টি কল পাচ্ছি।’
চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ এর তথ্য মতে, এ সময় বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ফোন কলের সংখ্যা আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অনেক পরিবারই করোনার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ এ সব পরিবারের অভিভাবকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মেয়েদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আবার করোনাকালে অনেক প্রবাসী অবিবাহিত যুবক দেশে ফিরে এসেছেন। তারাও অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে করেছেন। ইউনিসেফের মতে, দেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে আর ২২ শতাংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগে।
ইউনিনেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককলে বলেন, দারিদ্র অবশ্যই বাল্যবিবাহের অন্যতম প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তবে, কোভিডের কারণে আয় কমে যাওয়ায় দারিদ্র্যের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আমরা এখনো বিশদ তথ্য জানতে পারিনি।
বাল্যবিবাহ রোধে সরকারের পাশাপাশি যেসব বেসরকারি সংস্থা কাজ করে, তাদেরসহ সমন্বিত উদ্যগ প্রয়োজন বলে মনে করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রনালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল কর্মসুচির প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন। তিনি বলেন, সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করলে বাল্যবিবাহ কমে আসবে। তার মতে, ‘আইনের চেয়ে শিশুদের ভবিষ্যতের বিষয়টিকে বেশি প্রচার করতে হবে। পরিবার যখন বুঝতে পারবে তারা যে কাজটি করছে সেটি শিশুর ভবিষ্যত উজ্জল নয় বরং অন্ধকারে ঢেকে দেবে। তখনই পরিবার বাল্যবিবাহ থেকে সরে আসবে। বাল্যবিবাহের সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত।’
বাল্যবিবাহ নারী ক্ষমতায়নের প্রধান বাধা উল্লেখ করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। তিনি বলেন, ‘ভূয়া জন্ম নিবন্ধন দিয়ে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। এখানে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রয়েছে। এ সনদ জনপ্রতিনিধিরাই দিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’
জাতীয় কন্যাশিশু এডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার বলেন, ‘বাল্যবিবাহের ফলে একজন কিশোরী শুধু শারীরিক ভাবেই নির্যাতিত হয় না, মানসিক ভাবেও নির্যাতনের শিকার হয়’।