মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে : শামসুজ্জামান খান

680

॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
ঢাকা, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০ (বাসস) : বাংলা একাডেমির সভাপতি, বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট জনপদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সেই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির ওপর প্রভাব ফেলে। লোকজ সংস্কৃতির প্রতিটি ধারায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ রয়েছে। সে লোকসাহিত্য বলুন, লোকশিল্প বলুন আর লোকগানই বলুন না কেন, আমাদের লোকজ সংস্কৃতি এতোটাই সমৃদ্ধ যে তা মুক্তিযুদ্ধে প্রভাবক হিসেবেও কাজ করেছে।’
পঞ্চাশতম বিজয় দিবসকে সামনে রেখে বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাতকাওে দেশের ফোকলোর গবেষণার অন্যতম পথিকৃত শামসুজ্জামান খান এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন মানুষের মুখে মুখে রচিত লোকগান, লোকছড়া, পুঁথি, লোকশিল্প লোকজসংস্কৃতির এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে রচিত লোকগান, ছড়া, পুঁথি ও গল্পগাঁথা লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সৃষ্টি হয়েছে লোকজ সংস্কৃতির বহু উপাদান-উপকরণ। এসব উপাদান লোকসংস্কৃতির ওপর যেমন প্রভাব ফেলেছে, তেমনি স্বাধীনতাকামী মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করেছে।
বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক শাহিদা খাতুন বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লোকসংগীতের অবদান সর্বাগ্রে। আমাদের লোককবি ও চারণ-কবিদের রচিত গানের কথায় ও সুরে স্বাধীনতাকামী আপামর জনগণের সাথে লোকসমাজও উজ্জীবিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান, পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন, রাজাকার-আলবদরের অত্যাচার, নির্মম নৃশংসতা, হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা ইত্যাদিসহ বঙ্গবন্ধুকে আবর্তিত করে মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে লোকসঙ্গীত শিল্পীরা জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, ধুয়া, বিচারগান, কবিগান প্রভৃতি ধারার অজস্র গান তৈরি করে গেয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের সাধক, কবিদের রচনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন দেখা যায়। যেখানে লোকসাহিত্যের এক অভাবনীয় উপকরণ হয়ে উঠেছে মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধ।
ফোকলোর গবেষক ও বাংলা একাডেমির সহকারী পরিচালক সাইমন জাকারিয়া ‘সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি’ গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সাধক কবি শাহ আবদুল করিমের গানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘পল্লীগ্রামের কবি আমি পল্লীর গান গাই/স্বাধীন দেশে শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চাই-/তাই তো মনে পড়ে॥” এই লেখনিতে মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের মনের ভাব প্রকাশ পেয়েছে।
একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণই যে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধকালীন ও পরবর্তী বিভিন্ন রচনায় আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই। লোকসাহিত্যেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের লোককবিদের রচনায় এর প্রতিফলন দেখা যায়।
গোপালগঞ্জের পুথি-সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী তরুণ পুথিকার কবি শেখ মিজানুর রহমানের ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ’ শীর্ষক পুঁথির উল্লেখ করে সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও পাকিস্তান শাসকদের পরাধীনতা থেকে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম সূচনার যুগসন্ধিক্ষণের অতি আকাংখিত ঘটনার কথা এই পুঁথির কাব্যিক বুননে ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাঞ্জনায় বর্ণিত হয়েছে। যাতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সুগভীর দূরদর্শিতাকে কবি মন্থন করেছেন।
এখানে কবি ৭ মার্চের ভাষণকে রেসকোর্স ময়দানে রচিত ‘গীতিকাব্য’ হিসেবে শনাক্ত করেছেন। ‘উনিশশো একাত্তর সালে সাতই মার্চের দিনে/ গীতিকাব্য রচিত হয় রেসকোর্স ময়দানে/ জাতির পিতার মুখের বুলি ভাষণ কথকতা/ইতিহাস রচিল বিশ্বে পেলো অমরতা।
শাহিদা খাতুন বলেন, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা ও আলকাপ গান লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। আলকাপ ও গম্ভীরা গানে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন ঘটনা ও বঙ্গবন্ধুর কথা নানাভাবে উঠে এসেছে। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাঙালির গৌরবজনক অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধই হয়ে ওঠে গম্ভীরা গানের প্রধানতম বিষয়। একাত্তরের চরম সংকটকালে রচিত লোকসঙ্গীতগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ।
একাত্তরের নয়মাসে লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত বিষয় লোককাহিনি, কিংবদন্তি, প্রবাদ ও লোকছড়ার নতুন নতুন উপাদান সৃষ্টি হয়েছে। এসময় নতুন প্রবাদ যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি প্রচলিত প্রবাদের সাথে নতুন কথা যুক্ত হয়েছে। যেমন- ‘নদী মাঠে জঙ্গলে, আমরা মারবো কৌশলে”; “ওস্তাদের মার শেষ রাতে, আমরা মারবো হাতে আর ভাতে’; “বাঙালি জান দেবে কিন্তু মান দেবে না’ ইত্যাদি। এসব প্রবাদ স্থানীয় এবং সামগ্রিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
বেশিরভাগ লোকছড়ার রচয়িতা গ্রাম্য নারীরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত লোকছড়ায় সেসময়ের সামাজিক চিত্র উঠে এসেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লোকসমাজের মানসপটে লোকছড়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। লোকছড়া নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে যে ধরনের সাহিত্য রচিত হয়েছে যেমন: ‘রাজাকার আর আলবদর, যেখানে পাস সেখানে ধর’; ‘ওরা মারে মানুষ, আমরা মারি পশু’;’ ‘শাহের বানু সাবধান, ঐ দেখা যায় টিক্কা খান’; ‘পরানে নাই ধর্মের কথা, তার নাম পাকসেনা”; ‘খোকা যাবে যুদ্ধে, তাকে দুধের ভাত দে’।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এদেশের লোকশিল্পকলাকেও সমৃদ্ধ করেছে। ফোকলোর বিশেষজ্ঞ শাহিদা খাতুন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক ঘটনার বিভিন্ন ছবি লোক ও কারুশিল্পীদের সৃষ্টিতে নানাভাবে বিধৃত হয়েছে। লোক ও কারুশিল্পীগণ বিশেষ করে মৃৎশিল্পী ও দারুশিল্পীগণ মাটি, কাঠ, পাথর, সিমেন্ট ও পোড়ামাটির তৈরি ভাস্কর্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় চিত্রিত করেছেন। লোকশিল্পের অনন্য নিদর্শন সুচিশিল্পে বিশেষত নকশি কাঁথায় চিত্রিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নকশার মোটিফদৃশ্য।
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় আকারে ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার আবহমান সংস্কৃতির এক আকর্ষণীয় আয়োজন এই লোকমেলা। ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রামের মাটিতে যুক্ত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা’। ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বিশেষত: ছাত্র শিবিরের তান্ডবের মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিলো এই “বিজয় মেলা”। পরবর্তীতে এই মেলার নামকরণ করা হয়, “মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা”।
বিজয় মেলার প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া। এই মেলা সম্পর্কে তিনি বাসসকে বলেন, ‘আশির দশকে জামাত-শিবিরের তান্ডবে বৃহত্তর চট্টগ্রামে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। সেসময় সাধারণ মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে এবং জামাত শিবিরের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে লোকঘনিষ্ট এই ‘বিজয় মেলা’ আয়োজন করা হয়।”
এই মেলায় সারাদেশ থেকে লোককবি, লোকসঙ্গীত শিল্পীরা অংশ নেন। এতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনার পাশাপাশি, লোকগান, জারিসারি ও সার্কাসের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে সারাদেশেই ডিসেম্বর মাসজুড়ে বিজয় মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
শাহিদা খাতুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সৃষ্টিগুলো এদেশের লোকমানুষেরই কণ্ঠস্বর। লিখিত বা মৌখিক যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেনো এসব উপাদান বাংলার লোকঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। তাই বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন যেসব ঘটনা লোকজ সংস্কৃতিতে বিধৃত হয়েছে সেগুলো ঐ সময়ের চিত্রকে ধারণ করে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে লোকজ উপাদানসমূহ নিঃসন্দেহে মূল্যবান দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।