পরিবেশের বহুমাত্রিক দূষণ শিশু স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি

845

॥ এমরানা আহমেদ ॥
ঢাকা, ১০ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : অনিমা রহমানের ফ্ল্যাট রাজধানীর ইস্কাটন এলাকায়। রাস্তার পাশে ফ্ল্যাটটির অবস্থান হওয়ায় দিনরাত প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই শব্দ দূষণের শিকার হতে হচ্ছে গৃহিনী অনিমা, তার পাঁচ বছর বয়সী শিশু তামান্নসহ তাদের পরিবারের সকল সদস্যকে। তাদের প্রায় সবাই বর্তমানে কানে কম শোনে। আস্তে কথা বললে তারা এখন আর শুনতে পান না। তাদের ছোট্ট শিশুটির অবস্থাও তাদের মতোই হয়ে গেছে। সে এখন কানে কম শোনে। এর জন্য চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসক তাদের রাস্তার পাশে ফ্ল্যাট ছেড়ে নিরিবিলি এলাকায় বাসা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যথায়, তাদের শিশু সন্তানটি ভবিষৎতে কানে শুনতে পারবে না এবং অতিরিক্ত শব্দ দূষণে তার ব্রেনেও সমস্যা দেখা দিতে পারে ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, শব্দ দূষণের ফলে ০-৫ বছর বয়সী শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ বাচ্চাদের মেজাজ খিটমেটে করে তুলে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেয়। পরবর্তীতে পড়াশুনায় অমনযোগী হয়ে পড়ে তারা। তাদের আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এভাবে শব্দ দূষণ চলতে থাকলে বাতাসের যে মরমর শব্দ ভবিষৎতে সেটাও আর শুনতে পারবে না শিশুরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শহরে বেড়ে ওঠা শিশুরা মাঠের অভাবে খেলাধূলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে শিশুদের স্ব^াভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাংঘাতিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচেছ। পরবর্তীতে এসব শিশুরাই নানা ধরনের অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলে প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে এই শব্দ দূষণও অন্যতম কারন বলে মত দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা বিশ্বে ১৫ বছরের নীচে প্রায় ১কোটি শিশু বিভিন্ন পরিবেশ দূষণ জনিত কারণ- দূষিত পানি, খাবার এবং দুর্ঘটনায় মারা যায়। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট শিশুদের প্রায় ৪৫ শতাংশ দারিদ ্রসীমার নীচে বাস করে। এদের সংখ্যা হবে প্রায় ৩ কোটির অধিক। এসব শিশুদের মাঝে আবার ৪১ শতাংশের কোন আশ্রয় নেই। আবার ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃসেবা থেকে বঞ্চিত। ৫৭ শতাংশ দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োাজনীয় পুষ্টি পায় না। ১৬ ভাগ স্বাস্থ্য সেবা এবং ৩ ভাগ শিশু সুপেয় পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। আর এ সমস্ত বঞ্চনার সাথে যখন যোগ হয় পরিবেশ দূষণ, তখন হত-দরিদ্র, সুবিধা-বঞ্চিত পরিবারের শিশুরা মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আক্রান্ত হয়। পরিবেশ দূষণের কারণে আমাদের বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিনিয়ত মৃত্যু ছাড়াও বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়া হচ্ছে অন্যতম।
চলতি বছরের ৬ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানাগেছে, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণের ফলে প্রতিবছর ৫ বছরের কমবয়সী প্রায় ১৭ লাখ শিশু অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। কারণ হিসেবে অনিরাপদ পানি, স্যানিটেশনের অভাব, দরিদ্র স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন ও পারিপার্শ্বিক দূষণের পাশাপাশি আহত হওয়াকেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে সংস্থাটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চ্যান এক বিবৃতিতে বলেন, বর্তমান সময়ে শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে ভয়াবহ কারণ হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। দূষিত বাতাস ও পানি শিশুদের কোমল অঙ্গ, ইমিউন সিস্টেম এবং শ্বাসনালীর পরিপক্বতায় বাধা দিয়ে তাদের শারীরিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এ ছাড়া শিশুদের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কমে যায়।
রাজধানীতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক জরিপে দেখা যায়, নীরব এলাকার আওতাভুক্ত হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতের আশেপাশে দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা ৭৫-৯৭ ডেসিবল যা আন্তর্জাতিক মাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুন বেশি।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল ও রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ রাতে ৪৫, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০, রাতে ৫০ এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ রাতে ৭০ ডেসিবল।
বিধিমালার আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ৬ মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডীত হওয়ার বিধান রয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তা ও অলিগলিতে আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে। খোলা ট্রাক ও কনটেইনারে আবর্জণা পরিবহনের ফলে পথে পথে ছড়িয়ে পড়ছে আবর্জনা, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধসহ নানা রোগ ব্যাধির জীবাণু। ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) এর এক কর্মকর্তা বলছেন, জাইকার সহায়তায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেশ উন্নতি হবে। তারা বলছেন, ডিসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজ দায়িত্ব পালনে যতœবান না হলে রাজধানীর আবর্জনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
গবেষণায় দেখা গেছে- পরিবেশগত কারণ বিশেষত: শিশু জন্মের পূর্বে ও পরে মায়ের দৈহিক স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি শিশুস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। তাই, নবজাতককে জন্মপূর্ব এ সকল রোগ ও মৃত্যু ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন প্রসূতির জন্য শিশুর জন্ম পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার এবং পরিবেশ সম্মত আবাসস্থল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এ আর হাওলাদার বলেন, গাড়ির রং-এ ব্যবহƒত ‘থিনার’ এবং পুডিং তৈরিতে ব্যবহƒত ‘হার্ভেনার’ কেমিক্যালগুলোর গ্যাস খুবই প্রকট। চোখ জ্বালাপোড়া করে, মাথা ধরে। সর্দিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এর বিষাক্ত গ্যাসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন। তিনি আরো বলেন, গাড়ি মেরামতের ওকার্কশপে বিষাক্ত ক্যামিকেলের গ্যাস শ^াস-প্রশ^াাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ নানা রকম পেটের অসুখে আক্রান্ত হতে পারে। এই গ্যাস নিঃশ^াসের সাথে পাকস্থলিতে প্রবেশ করে আক্রান্ত ব্যক্তির খাবারে অরুচি দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ঠিকমত খেতে না পারার কারণে অপুষ্টির শিকার হতে পারেন আক্রান্ত ব্যক্তি। জনস্বার্থ বিশেষ করে শিশুদের স্ব^াস্থ্যের কথা চিন্তা করে, তিনি ওয়ার্কশপ মালিকদের যত্রতত্র গাড়ি মেরামতের কাজ বন্ধের পরামর্শ দেন।