বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে সহযোগিতার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

1113

ঢাকা, ২৮ অক্টোবর, ২০২০ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে আর্তমানবতার সেবায় জনগণ এবং সরকারের সহযোগী হিসেবে করোনার কারণে সরকারের দেয়া প্রণোদনার আওতায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রদেয় ঋণ কর্মসূচিতে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘সরকারি ব্যাংক দিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও যদি এগিয়ে আসে তাহলে শুরুতে হয়তো একটু সমস্যা হবে। তবে, ব্যবসা-বাণিজ্য যদি শুরু হয়ে যায় তবে সেরকারি ব্যাংকগুলোও লাভবান হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের প্রণোদনা প্যাকেজে আমরা যে সব সুযোগ দিয়েছি তাতে অল্প সুদে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তার একটি পদক্ষেপ রয়েছে। তবে, এ ব্যাপারে আমি মনে করি, আমাদের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আরেকটু আন্তরিক হওয়ার দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা যেহেতু প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের পাশে দাঁড়ান, আমি বলবো, এক্ষেত্রেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ দুপুরে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংক (বিএবি) নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেয়া ভাষণে একথা বলেন।
৩৫টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংগঠন বিএনবি’র পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে আসন্ন শীত মওসুম উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে ২৫ লাখ ৯৫ হাজার পিস কম্বল প্রদান করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এই অনুদান গ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা ব্যাংক এসোসিয়েশনের এই সহযোগিতাকে ‘বদান্যতা’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘যখনই দেশে কোন দুর্যোগ-দুর্বিপাক দেখা দেয় তখনই বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংক (বিএবি) নেতৃবৃন্দ মানুষের পাশে দাঁড়ান। তাঁদের এই বদান্যতার কারণে আমরা মানুষকে অনেক সহযোগিতা করতে পারি।’
তিনি বলেন, এবার যেভাবে বৃষ্টি হয়েছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে শীতের সময় এর প্রকোপটাও বেশি হতে পারে। সেজন্য শীত আসার আগেই বিএবি নেতৃবৃন্দ কিছু শীতবস্ত্র তথা কম্বল দেয়ার প্রস্তাব দেওয়ায় আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি। কারণ, মানুষের কাছে আমরা এটা পৌঁছতে পারবো এবং শীতে মানুষের উপকার হবে, সেজন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব কিছুতে বাংলাদেশসহ বিশ^ব্যাপী স্থবিরতা নেমে আসার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের সাহস ও মনোবলের প্রশংসা করেন এবং করোনা মোকাবেলায় তাঁর সরকারের সময়োচিত ও যথাযথ পদক্ষেপের উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি এইটুক বলতে পারি আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক হিসেবে কাজ করছি। কাজেই যেকোন দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবেলা করার মত বাংলাদেশের মানুষের মনোবল আছে এবং সাহস আছে।’
তিনি বলেন, ‘সেই সাহসিকতা নিয়েই এ দেশের মানুষ চলে, যে কারণে এই করোনাভাইরাস থাকার পরেও আমাদের অর্থনীতির চাকাকে আমরা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। তাছাড়া, আমরা যে প্রণোদনাটা দিয়েছি তাতে সকলেই ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার মত প্রণোদনা পেয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশের মত প্রণোদনা দিয়েছি। সেটা ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষ এবং সাধারণকে অন্তর্ভূক্ত করে করা হয়েছে। যার ফলে কিছুটা হলেও মানুষ স্বস্তি ফিরে পেয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, ব্যবসায়ীদের নানা প্রণোদনা এবং সহযোগিতা আমরা দিয়ে যাচ্ছি বলেই এই করোনাভাইরাস যতটা খারাপ অবস্থা আমাদের অর্থনীতির করতে পারতো সেটা পারে নাই। আমরা সেটা মোকাবেলা করে যাচ্ছি।
করোনার কারণে বাংলাদেশে তাঁর সরকারের পরিচালনায় সাম্প্রতিককালে কাঙ্খিত অগ্রগতি কিছুটা কম হলেও সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপে ৫ ভাগের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভবপর হয়েছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
খাদ্য উৎপাদনে তাঁর সরকার সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করোনার মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বার বার আসা সত্বেও আজকে আমরা ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়েছি।’
‘খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা একান্তভাবে প্রয়োজন’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রচলিত একটি প্রবাদ ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’ উদ্ধৃত করে বলেন, তাঁর সরকার সেটাই মেনে চলছে।
তাঁর সরকারের উন্নয়নের মূল লক্ষ্য গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন-এই অভিমত ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানন্ত্রী বলেন, ‘আপনি যতই বিদেশে রপ্তানি করেন না কেন, দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতাটা বাড়াতে হবে। তাহলে উদপাদিত পণ্যের একটি বিশাল বাজার দেশেই সৃষ্টি হবে।’
দেশে একসময় বর্তমানের মত এত বেসরকারি ব্যাংক ছিল না উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘অনেক বাধা বিঘœ ছিল, অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার আপত্তি ছিল বরং ব্যাংকের অলাভজনক শাখাগুলো বন্ধ করে দেওয়ারও পরামর্শ ছিল কিন্তু আমরা তা শুনিনি।’
তিনি কারণ হিসেবে বলেন, দেশটা আমাদের এবং আমরা জানি দেশের উন্নতি কিভাবে করতে হবে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে সব সময়ই সচেতন। সে কারণে আামি ব্যাপকভাবে প্রাইভেট ব্যাংক দিয়ে দিয়েছি বলেই আমার সব থেকে লাভ যে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়ার সময় নীতিমালাতেই ছিল রাজধানীর বাইরে শাখা করতে হবে এবং সামাজিক সহযোগিতা করতে হবে। পাশাপাশি, সরকারি ব্যাংকও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। যে কারণে, যেকোন দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা আমাদের জন্য সহজ হচ্ছে। আবার তাঁরা নিজেরাও করছেন।’
তিনি ব্যাংক ব্যবহারে দেশের মানুষকে অভ্যস্থ করে তোলায় উদ্যোগ গ্রহণে ব্যাংক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাঁর সরকার কৃষকদের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা করাতে এখন প্রবাসীদের টাকাটাও ব্যাংকের মাধ্যমেই আসছে। ফলে, সরকার, জনগণ এবং ব্যাংক উভয়ই লাভবান হচ্ছে, বলেন তিনি।
‘মুজিববর্ষে’ দেশে কোন গৃহহীন না রাখার দৃঢ় প্রত্যয় পুণর্ব্যক্ত করে স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ পুণর্গঠনকালে বঙ্গবন্ধুর ভুমিহীনদের মাঝে খাসজমি বিতরণ এবং ঘর-বাড়ি তৈরী করে দেওয়ার ‘গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প’ এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ’৯৬ পরবর্তী সময়ে চালু করা ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ চালুর পদক্ষেপ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্যাংক এসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দকেও সরকারের এই কাজে সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘বিএবি নেতৃবৃন্দকে আমি অনুরোধ করবো, আপনারাও নিজেদের এলাকায় ভূমিহীন বা গৃহহীনদের ঘর-বাড়ি তৈরী করে দিতে পারেন। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে দিচ্ছি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও দিচ্ছে। সেভাবে আপনারা মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন।’
তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে যে অনুদান দিচ্ছেন সেটাও ঐসব দরিদ্র জনগণ এবং আর্তমানবতার সেবাতেই কাজে লাগছে। ফলে, মানুষকে তাঁর সরকার ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করতে পারছে, বলেন তিনি।
তাঁর সরকার সকল দরিদ্র শ্রেনীর জনগণের জন্য সহযোগিতার হস্তকে প্রসারিত করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমরা সকল শ্রেনী পেশার মানুষের জন্য করছি। তাই, আমরা মনে করি, সকলে মিলে একটু করে সাহায্য করতে পারলে দেশে আর কোন দরিদ্র থাকবে না।’
তাঁর সরকার দেশের দারিদ্রসীমা ২০ দশমিক ৫ ভাগে নামিয়ে এনেছিল এবং আরো কমিয়ে আনার বিষয়টি করোনার কারণে কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও পূণরায় পূর্বাবস্থায় দেশের অর্থনীতিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় আশাবাদ ও ব্যক্ত করেন সরকার প্রধান ।
তিনি বলেন, ‘তাহলেই বাংলাদেশকে আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত করতে পারবো এবং বাংলাদেশের মানুষ যেন সুন্দর জীবন পেতে পারে সেই ব্যবস্থা আমরা করবো।’
শেখ হাসিনা বলেন, একটি দেশের উন্নয়ন সরকার যেমন কাজ করবে তেমনি বেসরকারি খাতও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেজন্য তাঁর সরকার বেসরকারি খাতকে উঠে আসার বিভিন্ন ক্ষেত্র প্রস্তুতির কাজ ’৯৬ সালে প্রথমবার সরকারের আসার পর থেকেই করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী করোনার সেকেন্ড ওয়েভ সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, আমাদের দেশে এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আপনারা ইতোমধ্যে দেখেছেন ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে আবারো করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে, ‘সেক্ষেত্রে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। নিজেকে সুরক্ষিত করুন এবং অন্যকেও সুরক্ষিত রাখুন।’
তাঁর সরকার এ বিষয়েও বেশ কিছু প্রস্ততি নিয়ে রেখেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্তে সরকারের প্রস্তুতি চলছে এবং অচিরেই সকলে জানতে পারবেন।
তিনি বলেন, ‘এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে এবং জীবন যাত্রায় কোন প্রভাব না পড়ে যেজন্য সকলকে সচেতন হতে হবে।’
দেশে সরকার একশ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে এবং দেশের রিজার্ভের পরিমান ৪০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের টার্গেট রয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে রিজার্ভের পরিমান অন্তত ৫০ বিলিয়ন যেন হয়। একই সঙ্গে দেশের উন্নয়নের কাজগুলো অন্যের থেকে অর্থ নিয়ে নয়, নিজেদের অর্থে এবং ব্যাংক লোনের মাধ্যমে যেন করতে পারি।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। কারো কাছ থেকে হাত পেতে নয়, ধার করে নয়, বিশে^ মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে চলতে চাই।
শেখ হাসিনা দৃপ্ত কন্ঠে বলেন, ‘জাতির পিতা আমাদের যে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, তাঁর সুফল প্রত্যেক ঘরে আমরা পৌঁছে দিতে চাই।’