জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পরিণতি

766

॥ কানাই চক্রবর্ত্তী ॥
ঢাকা, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ (বাসস) : জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেয়ার দিনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের সুন্দরতম ও সর্বশ্রেষ্ঠ একটি দিন। একইভাবে বলা চলে বাংলায় বক্তৃতা তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) সমগ্র জীবনের স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক পরিণতি।
আগামী কাল ২৫ সেপ্টেম্বর সেই ঐতিহাসিক দিন, ৪৬ বছর আগে ১৯৭৪ সালের এইদিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন।
এর আগে একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশের মর্যাদা লাভ করে। এর মাত্র সাত দিন পর, ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘর সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দেন। জাতিসংঘে এটিই ছিল প্রথম বাংলায় ভাষণ। এর মাধ্যমে বাংলাভাষা বিশ্ব দরবারে পেয়েছে সম্মানের আসন, আর এই ভাষাভাষী মানুষ পেয়েছে গর্ব করার অবকাশ।
অনেকেই মনে করেন, বিশ্বপরিসরে এর আগে বাংলা ভাষাকে এমন করে কেউ পরিচয় করিয়ে দেননি।
এ ভাষণের আর একটি দিক হল এটি সমগ্র বিশ্বের অধিকারহারা শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সোচ্চার এক কণ্ঠস্বর। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ।
ভারতের প্রখ্যাত লেখক ও গ্রন্থ সমালোচক সুরজিৎ দাশগুপ্ত জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ দেয়ার দিনটিকে তাঁর (বঙ্গবন্ধু) জীবনের সুন্দরতম ও সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হিসাবে অবিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এর আগে শেখ মুজিবুর রহমান নিজে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও লাহোরে মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে রাজি হলেন এই শর্তে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবে। পাকিস্তানের স্বীকৃতির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের স্বীকৃতি এবং এই সঙ্গে জাতিসংঘে প্রবেশের অধিকার আর বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অন্যতম ভাষারূপে প্রতিষ্ঠার সুযোগ। ’
সৈয়দ বদরুল আহসানের ‘শেখ মুজিবুর রহমান : ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার’ গ্রন্থেটির ওপর আলোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত লেখক ও গ্রন্থ সমালোচক সুরজিৎ দাশগুপ্ত ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই মূল্যায়ন করেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ভারতের নয়াদিল্লী থেকে। প্রকাশক নিয়োগী বুকস।
গ্রন্থ আলোচনায় সুরজিৎ দাশগুপ্ত আরো বলেন, এটা ঘটনা যে, জাতিসংঘের দরবারে ভারতীয় ভাষাগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাই সারণি-স্বীকৃত ভাষা। স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বাংলা ভাষার এই গৌরব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলেন, এই ভাষার জন্যই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ‘অমর একুশে’ এর ঐতিহাসিকতা অর্জন করে। এর ৪৮ বছর পর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেন, ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, আবুল হাসিম, কামিনী কুমার দত্ত, শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ তৎকালীন বাংলার নেতৃবৃন্দ। তখন মুজিবুর ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর একান্ত অনুগত। সেই সময় থেকে তিনিও স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতেন।
তিনি বলেন, মুজিবুর কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে সেখানেও ছাত্রনেতা হলেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেফতার হন এবং ১৫ মার্চ মুক্তি পান। আবার আইন অমান্যের জন্য ১৯৪৯ সালের ২৯ এপ্রিল গ্রেফতার হন। মুক্তি পান ২৭ জুলাই। চার মাস পর খাদ্য আন্দোলনের নেতা হিসেবে আবার কারাবাস। বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন জেলে একটানা প্রায় দু’বছর বন্দি রেখে ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে যখন তাকে মুক্তি দেয়া হয়, তখন তাঁকে স্ট্রেচারে করে বাড়ি নিয়ে যেতে হয়।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মুজিবুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ফিরলেন খাদ্যাভাবে হাহাকার ক্লিষ্ট, গুপ্ত মারণাস্ত্রে সজ্জিত তারুণ্যপরিবৃত, যাদের কেউ কেউ ধর্মান্ধতায় উগ্র, দেশের অন্দরে আর দেশের বাইরে আমেরিকা, চীন প্রভৃতি বিরূপ বিশ্বশক্তি সঙ্গে নিয়ে। এসবের সঙ্গে আছে পাকিস্তানে আটকেপড়া প্রায় এক লক্ষ বাংলাভাষী আর বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় আড়াই লক্ষ উর্দুভাষী এবং ভারতে হস্তান্তরিত যুদ্ধবন্দিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন। তবে, এত কিছুর পরও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকীতে আইনের শাসন ও বহুত্ববাদের ভিত্তিতে গৃহিত হয় বাংলাদেশের সংবিধান।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ঐতিহাসিক এ দিনটির সূচনা হয় একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর, বুধবার। বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গহণ করা হয়।
তিনি বলেন, এই ঘোষণাটি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি সুখী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।’
প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এই ২৯তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে অনুরোধ করা হয়েছিল, ইংরেজিতে বক্তৃতা করার জন্য। কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চান।’ সিদ্ধান্তটি তিনি আগেই নিয়েছিলেন উল্লেখ করে তোফায়েল বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরু দায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দেয়ার বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তটি ছিল তাঁর সমগ্র জীবনের স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক পরিণতি। সেদিন বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, তিনি যেন বহু যুগ ধরে এমন একটি দিনের জন্য অপেক্ষায় থেকে নিজকে প্রস্তুত করেছিলেন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও জাতির পিতার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিভিন্ন অধিবেশনে মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিচ্ছেন। এবারও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (৭৫তম ) অধিবেশনে ভার্চূয়াল অংশ গ্রহনে বাংলায় ভাষণ দেবেন।