নীলফামারীতে ভাসমান বীজতলা সাড়া ফেলেছে কৃষকদের মাঝে

533

নীলফামারী, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ (বাসস) : জেলায় অতিবৃষ্টির জলাবদ্ধতা আর বন্যার দুর্যোগে আমন বীজতলা নষ্ট হওয়ার দুঃচিন্তা দূর করতে পারে ভাসমান বীজতলা। এমন চিন্তা থেকে এবার ১০০টি বীজতলা তৈরী করেছে কৃষি বিভাগ। আপদকালীন হিসেবে এসব বীজতলার চারা প্রদান করা হচ্ছে কৃষকদের মাঝে।
কৃষি বিভাগ বলছেন, বীজতলা তৈরীর পরীক্ষামূলক এ পদ্ধতিটি কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পরলে বন্যার দূর্যোগেও চারার অভাবে আমন আবাদে বিরূপ প্রভাব পড়বেনা। অপরদিকে কৃষকরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে পতিত ডোবা, পুকুর এবং জলাশয়ের পানিতে ভাসমান বীজবলা তৈরী করা গেলে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে। বীজতলার জমি স্বাশ্রয়ে ওই জমিতে অন্য ফসলে বাড়তি আয় করা যাবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় এবারে ১ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষমাত্রা পূরণে বীজতলা তৈরী করা হয় ৬ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে। এসব বীজতলার মধ্যে রয়েছে জেলা সদরে ১ হাজার ৫৮০ হেক্টর, সৈয়দপুরে ৪৬০ হেক্টর, ডোমারে ১ হাজার ৭৫ হেক্টর, ডিমলায় ১ হাজার ৬২ হেক্টর, জলঢাকায় ১ হাজার ৩০৮ হেক্টর এবং কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ৮৬০ হেক্টর। এবারের কয়েক দফার তিস্তার বন্যায় ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলায় ৬০৭ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়। এর মধ্যে ডিমলা উপজেলায় ৪৫০ হেক্টর আমন ক্ষেত ও ১৫ হেক্টর বীজতলা, জলঢাকা উপজেলায় ৮৫ হেক্টর আমন ক্ষেত ও ১৫ হেক্টর বীজতলা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়। বন্যার স্থায়িত্ব কম হওয়ায় বীজতলার তেমন ক্ষতি না হলেও ওই দুই উপজেলায় আমন ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৬ দশমিক ৫ হেক্টর। ওই ক্ষতি পোষাতে ৩ একর কমিউনিটি বীজতলা এবং ১০০টি ভাসমান বীজতলা তৈরী করা হয়েছে। এসব ভাসমান বীজতলার দৈর্ঘ ১০ মিটার এবং প্রস্ত ১ দশমিক ২৫ মিটার। প্রতিটি বেড তৈরীতে কৃষিবিভাগের খরচ হয়েছে এক হাজার ৩৬৫ টাকা। পরীক্ষামূলকভাবে এসব ভাসমান বীজলা তৈরী করা হলেও এলাকার কৃষকদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে। এসব বীজতলার চারা কৃষকদের মাঝে বিলি করা হচ্ছে।
জেলা সদরের পলাশবাড়ি ইউনিয়নের তরণীবাড়ি অচিনতলা গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম (৩০) বলেন,“আমার বাড়ির পাশের পতিত একটি ডোবার পানিতে দুটি বেডে ভাসমান আমন বীজতলা তৈরী করেছে কৃষি বিভাগ। ওই বীজতলা তৈরীতে প্রয়োজন হয়েছে একটি কলার ভেলা। সেটির ওপর পথিন বিছিয়ে পুকুরের পলিমাটি তুলে দেওয়া হয়েছে। পলিমাটির সঙ্গে প্রতিটি বেডে আড়াই কেজি পরিমান বৈজসার মিশিয়ে এক কেজি ধানের বীজ ছিটানো হয়েছে। যা একটি শ্রমিক দিয়ে এক দিনেই তৈরী করা সম্ভব। জমিতে বীজতলা তৈরীতে চাষ এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া সমাপ্ত করতে বেশ সময় লাগে। ভাসমান বীজতলায় সে সময় লাগে না।”
তিনি বলেন,“আমাদের প্রচুর পুকুর-ডোবা এবং জলাশয় অব্যবহৃত থাকে। এসবের কোন ধরণের ক্ষতি না করে ভাসমাণ বীজতলার ধারণা এবারে প্রথম পেলাম। এটির ব্যাপকতা বাড়লে আমাদের বীজলার জমি অন্য ফসলের জন্য ব্যবহার সম্ভব হবে।” একই কথা বলেন ওই গ্রামের অনেকে।
সদর উপজেলা কৃষি বিভাগের পলাশবাড়ি ইউনিয়নের তরুণী ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পার্থপ্রতীম রায় বলেন,“এবারের অতিবৃষ্টি এবং বন্যার কারণে পরীক্ষামূলকভাবে আপদকালীন হিসেবে এসব ভাসমাণ বীজতলা তৈরী করা হয়েছে। এসব প্রদর্শনী বীজলা দেখে কৃষকদের মধ্যে বেশ আগ্রহ জম্মেছে। ওই বীজতলা তৈরীতে যেসব উপকরণ প্রয়োজন তা গ্রামের কৃষকদের কাছে খুবই সহজলভ্য। গ্রামের প্রতি কৃষেের বাড়িতে কলাগাছ থাকে। পরিত্যক্ত কলাগাছ ব্যবহার করে ভেলা তৈরীসহ বীজতলার বেড তৈরীর উপকরণ সংগ্রহ একজন কৃষকের পক্ষে খুবই সহজ। আমন চারা তুলে ওই বেডে বিভিন্ন শাকসবজি আবাদ করা সম্ভব। এমন সম্ভাবনায় ভাসমাণ বীজলায় আগ্রহী হচ্ছেন কৃষক। এটির ব্যাপকতা বাড়লে মাছের ক্ষতি না করে পতিত জলাশয়, পুকুর-ডোবার ব্যবহার নিশ্চিত হবে। অতিবৃষ্টি এবং বন্যার পানিতে ডুবে ওই বীজতলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই নেই।”
জেলা মৎস্য দপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় মোট পুকুর এবং জলাশয়ের সংখ্যা ২৯ হাজার ৭২৭টি। এসবের মধ্যে সরকারি ১৫৩টি এবং বেসরকারি ২৯ হাজার ৫৭৪টি। এসব পুকুর-জলাশয়ের মোট আয়তন ৩ হাজার ৯৪৭ দশমিক ৯৫ হেক্টর। ওই আয়তনের মধ্যে সরকারি পুকুরের আয়তন ১২২ হেক্টর এবং বেসরকারি পুকুরের আয়তন ৩ হাজার ৮২৫ দশমিক ৯৫ হেক্টর।
এবিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশরাফুজ্জামান বলেন,“একটি পুকুরের ১০ ভাগের এক ভাগ অংশ ব্যবহার করে ভাসমাণ বীজতলা তৈরী করা হলে মাছ চাষের কোন ক্ষতি হবে না। ববং সেটি মাছের সেলটার হিসেবে কাজ করবে। আর যদি গোটা পুকুরের পানিতে ভাসমান বীজতলা করা হয় তাতে সূর্যকিরণ বাধাগ্রস্ত হয়ে মাছের ক্ষতি করবে।”
এবিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. মাজেদুল ইসলাম বলেন,“আবহাওয়া যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে সে অনুযায়ী কৃষকদেরকে প্রশিক্ষিত করার জন্য প্রদর্শণী আকারে এবারে জেলায় ১০০টি ভাসমাণ বীজতলা তৈরী করা হয়েছে। পাশপাশি তিন একর জমিতে কমিউনিটি বীজতলায় আমন চারা তৈরী করা হয়। বন্যায় আমন আবাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আপদকালীন এসব বীজতলার চারা কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় বিনামূলে কৃষকদের মাঝে বিতরণ চলছে।” কৃষকরা প্রশিক্ষত হলে এমন আপদকালীন সময়ে তারা নিজেউ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবেন বলে জানান তিনি।