গৃহকর্মীদের রক্ষাকবচ ‘গৃহ শ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি’

1093

ঢাকা, ২১ আগস্ট, ২০২০ (বাসস) : রাহেলা আর তার স্বামী রাতুল দু’জনই চাকরীজীবি। তাদের দুই সন্তানের দেখভালের জন্য রয়েছে বাসায় পনের বছর বয়সী এক গৃহকর্মী। নাম খাদেজা (ছদ্মনাম)। তারা দু’জন অফিসে চলে যাওয়ার পর রাহেলার শাশুড়ী আর খাদেজা এই দু’জন মিলেই ছোট দুই বাচ্চাকে দেখা-শোনা করে। কিন্তু খাদেজার কাজের পান থেকে চুন খসলেই রাহেলার শাশুড়ী মারধর করেন। আবার রাহেলা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে তার কাছেও নালিশ করেন। রাহেলাও তাকে মারধর করেন। একবার তো গরম খুন্তির ছ্যাকা দেন পাঁয়ে। সেই ক্ষত নিয়েই বাসার সব কাজ করে যেত হত তাকে। প্রায় প্রতিদিনই তাদের বাসা থেকে মারধর আর কান্নার আওয়াজ শোনা যেত।
এভাবে বেশ কয়েকদিন চলার পর পাশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া এক মেয়ে পুলিশে ফোন দেয়। পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করে খাদেজাকে। গ্রেফতার করে রাহেলা আর তার স্বামীকে।
এমন অনেক গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়ত আসছে সংবাদ মাধ্যমে। আবার অনেক নির্যাতনের ঘটনা অপ্রকাশিতও থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সরকার গৃহ শ্রমিক নির্যাতন বন্ধে আন্তরিক। কিন্তু সাধারন মানুষই সচেতন নয়। অনেক শিক্ষিত লোকই তাদের বাসায় গৃহকর্মী নির্যাতন করে। এমনকি অনেক গৃহকর্মী যৌন নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে। আর এসব নির্যাতনের কিছু অংশ প্রকাশ হয়। আর অধিকাংশই অপ্রকাশিত থেকে যায়।
তারা বলেন, সরকার ২০১৫ সালে ‘গৃহ শ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি’ তৈরী করে । কিন্তু এ নীতি এখনো আইন করা হয়নি। আর এই সুযোগে গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতনও বেড়ে গেছে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা দ্রুত আইন করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ১৯৩ জন গৃহ শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-এর এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৪৯ জন গৃহ শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় যে নীতিমালা প্রণয়ন করে তাতে দেখা যায়- গৃহকর্মীকে চাকরি থেকে অপসারণ করতে হলে এক মাস আগে তা জানাতে হবে। গৃহকর্মীও যদি চাকরি ছাড়তে চান, তবে নিয়োগকারীকে তা এক মাস আগে জানাতে হবে। তাৎক্ষণিক ভাবে গৃহকর্মীকে চাকরি থেকে বাদ দিলে এক মাসের মজুরি দেওয়ার বিধান করা রয়েছে। পূর্ণকালীন গৃহকর্মী নিয়োগ দিয়ে তাঁর ছবিসহ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, গৃহকর্মী অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে, তবে নিয়োগকারী নিজে তাকে শারীরিক বা মানসিক শাস্তি দিতে পারবেন না।
এছাড়াও বলা হয় গৃহকর্মীর বয়স নূূন্যতম ১৪ বছর হতে হবে। তবে তাকে হালকা কাজ করাতে হবে। দেশের গৃহকর্মীরা বেতন সহ ১৬ সপ্তাহের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবে, যা গৃহকর্তাকে দিতে হবে। গৃহ শ্রমিকদের সহায়তার জন্য হেল্প লাইন চালু করতে হবে সরকারকে। এ ছাড়া কোনো গৃহকর্মী যৌন হয়রানি ও নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করলে সরকার সেই মামলা পরিচালনা করবে। আবার নীতিমালাটি বাস্তবায়নে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি তদারকি সেল থাকবে। কোনো গৃহকর্মী বঞ্চনা বা নির্যাতনের শিকার হলে মনিটরিং সেল, মানবাধিকার ও গৃহ শ্রমিক সংগঠনের কাছে টেলিফোনে, মৌখিক বা লিখিতভাবে অভিযোগ করতে পারবে। বিশ্রাম ও ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে নীতিমালায়।
মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট মনোয়ারা হক বলেন, নীতিমালায় যেসব বিষয়গুলোর উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রতিটি বিষয় সাধারন জনগন বিশেষ করে যারা গৃহকর্মী নিয়োগ দেন তারা যদি মেনে চলেন তবে নির্যাতন একেবারেই কমে যাবে। কিন্তু অধিকাংশই এসব নীতিমালা মানছেন না। আবার অনেকে এ নীতিমালা বিষয়ে সচেতনও নয়।
তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে কী পরিমান গৃহকর্মী বা শ্রমিক রয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
তিনি বলেন, এসব গৃহ শ্রমিকদের আইনের সুরক্ষায় এনে নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হবে। অন্যথায় নির্যাতন চলতেই থাকবে। আর সাধারন মানুষকেও এ সব গৃহকর্মীদের বিষয়ে আরো বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তাদেরকে সঠিক মর্যাদা দিতে হবে। এখানে সরকারের একার পক্ষে নির্যাতন বন্ধ করা খুবই কঠিন। তাই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।