নির্যাতিত নারী ও শিশুর সুরক্ষায় কাজ করছে ওসিসি

1378

॥ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন॥
নাটোর, ২০ আগস্ট, ২০২০ (বাসস) : বগুড়া-নাটোর সীমান্ত এলাকার নন্দীগ্রাম উপজেলার ছোট্ট গ্রাম দাঁড়িয়াপুর। এই গ্রামের ফুটফুটে মেয়ে জ্যোতি (ছদ্রনাম), হাসতো খেলতো বেড়াতো আর স্বপ্ন দেখে চলতো। কিন্তু হঠাৎ করেই জ্যোতির জীবনধারায় ঘটে ছন্দপতন। সে আর প্রজাপতির মত উড়েবেড়ায় না। ওর চুপ হয়ে যাওয়া পরিবর্তনে চিন্তিত বাবা-মা কিছুদিন পরেই লক্ষ্য করলেন তার শারিরিক কিছু উপসর্গ। স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে পরমর্শ করে করা হলো আল্ট্রাসনোগ্রাম। রিপোর্টে জানা গেল, জ্যোতির শরীরে অনাকাঙ্খিত মানব ভ্রুণের অস্তিত্ব। বাবার বয়সী এক প্রতিবেশীর কাছে পড়তে গিয়ে তার লালসার শিকার হয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়–য়া শিশু জ্যোতির জীবনে নেমে এসেছে এই অন্ধকার।
নাটোরে থাকা একজন সংবাদকর্মীর মাধ্যমে খবর যায় বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল (ওসিসি)-তে। তৎপর হন ওসিসি’র প্রোগ্রাম অফিসার রুহুল আমিন। ঐদিনই জ্যোতিদের বাড়িতে পৌঁছে গেল পুলিশ। ওসিসি’র তত্ত্বাবধানে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মেডিকেল টেস্ট এবং বিচারকের কাছে জবানবন্দী পেশ করা হয়েছে। অভিযুক্ত এখন কারাগারে।
নাটোর সদর উপজেলার পীরজিপাড়া গ্রামের রুহিনা (ছদ্রনাম) ধর্ষণের শিকার হয়ে ভর্তি হন সদর হাসপাতালে। হাসপাতালের রেজিস্ট্রার খাতা দেখে রুহিনার পাশে দাঁড়ায় হাসপাতালের ওসিসি। নাটোর থানায় মামলার ব্যবস্থা করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই সুব্রত জানালেন, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আর ওসিসি’র প্রোগ্রাম অফিসার মো. মুক্তার হোসেন জানালেন, মামলার আলামত সংরক্ষণ করা হয়েছে, প্রয়োজনে অভিযুক্তের ডিএনএ টেস্ট করা হবে।
সারাদেশে ৪৭টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং নির্বাচিত ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শারিরিক নির্যাতনের শিকার শিশু আর নারীর সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে এবং পুরনো জেলাগুলোতে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, নার্স, কাউন্সেলর, পুলিশ কর্মকর্তা আর আইন কর্মকর্তাসহ ব্যাপক জনবলের পরিধি নিয়ে কাজ করছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার। রাজশাহীসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে স্থাপন করা হয়েছে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরী। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ এর আওতায় চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ওয়াল্ড ইকনোমিক ফোরাম এর দি গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী, রাষ্ট্র ক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সারাবিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমাদের অবস্থান সপ্তম। আর লিঙ্গ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় এক নম্বরে। ইতিবাচক এই অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যায়, যখন পরিসংখ্যান ব্যুরোর রির্পোটে বলা হয়-দেশে বাল্য বিবাহের হার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ এবং বাল্য বিবাহের শিকার শিশুদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বিভিন্ন আইন প্রণয়ন এবং সহায়ক সব কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে সরকার নারী আর শিশুদের পাশে দাঁড়ালেও যখন তাদের প্রতি সহিংসতা রোধ করা সম্ভব হয় না।
দেশব্যাপী নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্যে সেবাপ্রাপ্তি সহজলভ্য করতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল (ওসিসি)। শুধু চিকিৎসা ও আইনগত সহায়তা প্রদানই নয়, নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সেবাপ্রাপ্তির সুবিধার্তে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় তৈরী করে ওসিসি। নির্যাতিত অস্বচ্ছল নারী ও শিশুদের জন্যে বিনামূল্যে সরকারি আইন সহায়তা পেতে লিগ্যাল এইডের সাথে সংযোগ করিয়েও দেয় ওসিসি। আর হাসপাতালগুলোতে নারী ও শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরীতেও কাজ করে থাকে ওসিসি। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের কাউন্সিলিং ও পেশাগত উন্নয়নে দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ সুবিধাও প্রদান করে ওসিসি।
নাটোর জেলা সদর হাসপাতালে ওসিসি’র প্রোগ্রাম অফিসার মো. মুক্তার হোসেন জানান, ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ১৪৭ জন শিশুসহ মোট ১ হাজার ২৬৬ জন নারী ও শিশুকে বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান করেছে এই সেল। এরমধ্যে ২০১৯ সালে ৫৬ জন শিশু ও ২২৬ জন নারীসহ মোট ২৮২ জনের মধ্যে ২৩৫ জনকে কাউন্সিলিং এবং ৩৭ জনকে আইন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
নাটোরের সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা. নাসরিন বানু বলেন, শুধু হাসপাতাল নয় শহর বা গ্রামের যে কোন প্রান্তে যে কোন শিশু নির্যাতনের শিকার হলে এবং এই খবর সরকারি সেবার ‘কল সেন্টার ৩৩৩ বা ৯৯৯’ বা ‘ন্যাশনাল হেল্প লাইন ১০৯’ এর মাধ্যমে অথবা অন্য যে কোন ব্যক্তির মাধ্যমে আমাদের কাছে এলে আমরা দ্রুত সক্রিয় হতে নির্দেশনা দেই ওসিসি’কে। এক্ষেত্রে চিকিৎসা ও আইনী সহায়তা দেওয়া যায় দ্রুততার সাথে।
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা জানান, নির্যাতনের শিকার যে কোন ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট থানায় গেলে প্রতিকার পাবেন। তবে, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের মাধ্যমে আসা নির্যাতিত নারী ও শিশুদের আইনী সহায়তা প্রদানে পুলিশ অগ্রাধিকার প্রদান করে।
লিগ্যাল এইড নাটোর জেলা কার্যালয়ের জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারি জজ মো. মতিউর রহমান বলেন, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সুপারিশকৃত মামলাগুলোকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করি, দ্রুত বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করার চেষ্টা করি। ক্ষেত্রবিশেষে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’র মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ ও বিবাদীপক্ষের মধ্যে আপোষ মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহন করি এবং এই উদ্যোগে সফলতা পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন উভয়পক্ষ।