সুস্থ জাতি গঠনে প্রয়োজন নিরাপদ মাতৃত্ব

1415

ঢাকা, ২০ মে, ২০২০ (বাসস) : শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার ছোট একটি গ্রাম সুবর্ণগাতি। এ গ্রামেই বাস করেন ১৮ বছর বয়সী আসমা। স্বামী সুজন মিয়া অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করেন। মাঝে মধ্যে কৃষি কাজ না থাকলে রিক্সা চালান।
অনেক ধুমধাম করে কিশোরী বয়সে আসমার বিয়ে হয়। গত দুই বছর আগে তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়েছে। আবারও সন্তান সম্ভবা। পরিবারের সকলের ইচ্ছা এবার একটি পুত্র সন্তান হবে আসমা’র। কিন্তু দুঃখের বিষয় আসমা আবারো কন্যা সন্তান হলো। বাড়ীর সবারই মন খারাপ। যতই দিন যাচ্ছে আসমা’র প্রতি সকলের অবহেলার মাত্রা যেন বেড়েই যাচ্ছে। অপুষ্টি আর অযতেœ আসমা’র শারিরীক অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে লাগলো। এক সময় আসমা’র প্রসব পরবর্তী জটিলতা দেখা দেয়। আসমার স্বামী সুজন মিয়া তাকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। কিন্তু অবহেলা আর অনাদরে আস্তে আস্তে নিঃশেষ হয়ে যায় আসমা। মা হারা হয়ে পড়ে অবুঝ দু’টি শিশু।
শিশুবিবাহ আমাদের সমাজে আইনত নিষিদ্ধ হলেও এখন পর্যন্ত গ্রামগঞ্জে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিয়ের বছর পার হতে না হতেই তারা গর্ভবতীও হয়ে পড়ছে। তারপর সে যখন মা হতে যায় তখন তার সংকট দেখা দেয় চারদিক থেকে। গ্রামাঞ্চলে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার বর্তমানে অনেক বেশি। কারণ, তাদের অনেকেই দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা আর কুসংস্কারের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় তাদের। সচেতনতার অভাবে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে পদে পদে।
বাংলাদেশ মাতৃস্বাস্থ্য জরিপ-২০১৬ এর তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ মাতৃমৃত্যুর কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। দ্বিতীয় কারণটি খিঁচুনি, এ কারণে ২৪ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয়। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব হলে মাতৃমৃত্যু কম হয়। দেশের ৪৭ শতাংশ নারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান জন্ম দেন। সরকারের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, গড়ে ধনী পরিবারের তিনজন মা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সন্তান জন্ম দেয়ার সুযোগ পান। গরিব পরিবারের ক্ষেত্রে এই সুযোগ কমে আসছে। ২০০৭ সালে ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য ছিল আট গুণ। ২০১১ ও ২০১৪ সালে পার্থক্য করে হয় যথাক্রমে ছয় ও পাঁচ গুণ। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (২০১৭-২০১৮) প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় সমাজের সবচেয়ে দরিদ্রশ্রেণীর মাত্র ২৬ শতাংশ মা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের সুযোগ পান। অর্থাৎ তারা হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সন্তান প্রসব করেন। ধনীদের ক্ষেত্রে এই হার ৭৮ শতাংশ।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার জীবিত শিশুর জন্ম হয়েছিল। আর বাংলাদেশ সরকারের ২০১৬ সালের মাতৃস্বাস্থ্য জরিপে দেখা যায়, দেশে এক লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়। বর্তমান সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন ও প্রসূতি মায়ের দক্ষ সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষে সরকার ব্যাপক কাজ করছে। বর্তমানে ২০১৯ সালে মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ১৭২ জন।
গ্রামীন দরিদ্র জনগোষ্ঠির মায়েরা যাতে হাতের কাছে মাতৃস্বাস্থ্য সুবিধা পান সে লক্ষ্যে প্রতি ৬ হাজার জনগোষ্ঠির জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শহরের বস্তি এলাকা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষে চর, হাওড়-বাওড় এবং পার্বত্য এলাকায় নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্বুদ্ধকরণ ও সেবা কার্যক্রম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন এবং সেই থেকে দেশব্যাপি ’নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ পালন শুরু হয়েছে। দিবসটিতে-মানসম্মত গর্ভকালীন সেবা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব এবং নারীর স্বাস্থ্য অধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
নারীর মাতৃত্বকে নিরাপদ করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে শিশুবিবাহ রোধ। প্রতিটি পিতামাতার উচিৎ তার মেয়ে সন্তানকে ১৮ বছর পুর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে না দেয়া। কারণ, এর আগে মেয়েদের জননতন্ত্র পূর্ণতা পায় না। নারী হিসেবে সংসার পরিচালনার মানসিকতা গড়ে ওঠে না। এছাড়া প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কেও তারা থাকে অজ্ঞ।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে গত কয়েক বছরে সাফল্য এলেও এখনো অনেক সমস্যা রয়েছে। চিকিৎসকদের বিপরীতে নার্সের সংখ্যা অনেক কম। প্রয়োজনের তুলনায় প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সংখ্যাও কম। কিন্তু মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমাতে তাদের ভূমিকা অপরিহার্য। একজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত নার্স-ধাত্রী তৈরীতে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
প্রসবকালীন যতœ ছাড়াও প্রসবপরবর্তী জরুরি কিছু যতœ আছে যা প্রসুতি মা ও সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। যেমন-মাকে সর্বদা পরিস্কার রাখা, মায়ের জন্য পর্যাপ্ত সুষম খাবার, বিশ্রাম ও যতেœর ব্যবস্থা করা। শিশুর নাভীর যতœ, শিশুর টিকা ও শিশুর খাবার হিসাবে মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ইসলামে প্রসুতি ও নবজাতকের জীবন রক্ষার জন্য জোরালো তাগিদ দেয়া হয়েছে। মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষার অভাব ও ধর্মীয় গোঁড়মির কারণে গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা প্রতিবছর সন্তান ধারন করে থাকেন। এ কারণে শিশুর সঠিক পরিচর্যা না হওয়ায় পুষ্টিহীন ও রোগাক্রান্ত মা ও শিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাকে পুর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয়। তাকে ভারী ও কঠিন কাজ না দিয়ে তার কষ্ঠ লাঘব করা যায়। ঘন ঘন সন্তান প্রসব থেকে বিরত রাখার জন্য মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এগিয়ে এসে জনগণকে সচেতন করতে সঠিক পরামর্শ দিতে হবে। যেসব মা স্বাস্থ্য সেবা পান না তাদের কাছে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে হবে। প্রসূতির প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পরিবার পরিকল্পনা সেবা আরও বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। মাতৃস্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও এর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। তাই, প্রসূতির নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার ও মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করে প্রসূতিকে সুস্থ রাখতে পারলে নবজাতক সুস্থ থাকবে এবং গড়ে উঠবে একটি সুস্থ জাতি।