কোভিড -১৯ মোকাবেলা করার প্রস্তুতি সম্পর্কিত অভিযোগ সরকার নাকচ করেছে

575

ঢাকা, ৩ এপ্রিল, ২০২০ (বাসস) : সরকার করোনাভাইরাস (কোভিট-১৯) মোকাবেলার পূর্ব প্রস্তুতির বিষয়ে কয়েকটি মহলের অভিযোগ নাকচ করে বলেছে যে, বাংলাদেশে মারাত্মক রোগটির প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে সরকার বিশ্বব্যাপী সঙ্কট শুরু হওয়ার আগে থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কাজ করেছে।
স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজিএইচএস) অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ বৃহস্পতিবার বাসসকে বলেছেন, “এ কথা মোটেও সত্য নয় যে, আমরা কোভিড -১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাব রোধে কোনও পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করিনি। আসল বিষয়টি হলো গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে মারাত্মক ভাইরাস প্রথম প্রকাশ পাওয়ার পরপরই আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছি,”।
তিনি বলেন, মানবজাতিকে মারাত্মক রোগ থেকে বাঁচাতে যখন উন্নত দেশগুলো সহ গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তখন কোভিড -১৯ এর প্রাদুর্ভাব রোধে বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে।
কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সরকারের নিরলস পদক্ষেপের বিবরণ দিয়ে ডিজিএইচএস মহাপরিচালক বলেছেন: “আমরা জানুয়ারী মাস থেকেই সংক্রমিত দেশ থেকে আগত লোকদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বিমানবন্দরে সন্দেহভাজনদের দেহ পরীক্ষা করা শুরু করেছি।”
অধ্যাপক আজাদ বলেন, ১৯ মার্চ থেকে বিদেশ থেকে আগত সকল যাত্রীকে সেনাবাহিনীর অধীনে বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আশকোনা হাজী ক্যাম্প এবং টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান কোয়ারেন্টাইন অব্যাহত রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।’
তিনি জানান, বিদেশে ফিরে আসা ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৯৩১ জনকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি আরও জানান, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিদেশ থেকে আগত লোকদের দেহ পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।
অধ্যাপক আজাদ জানান, সরকার ইতোমধ্যে অন-এ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোকে বিদেশী কোনও নাগরিককে ভিসা না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে।
তিনি বলেছিলেন, কোভিড -১৯ এর বিস্তার রোধ এবং এর চ্যালেঞ্জগুলোর বিভিন্ন মাত্রা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠন এবং বিভিন্ন টাস্কফোর্সকে সমন্বিত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রোগ প্রতিরোধের জন্য সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা নির্ধারিত হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করেছি এবং আমাদের স্বাস্থ্য পেশাদারদের প্রয়োজনীয় সুবিধা দিয়ে সজ্জিত করেছি,”।
অধ্যাপক আজাদ বলেন, জনগোষ্ঠীতে সংক্রমণ রোধে সরকার দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে, সংক্রমণ প্রবণ অঞ্চলগুলোকে লকডাউন করেছে এবং মানুষকে ঘরে বসে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, ২৬ মার্চ থেকে ১৪ দিনের জন্য ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার জরুরি সেবা ব্যতীত সকল সরকারী ও বেসরকারী অফিস এবং কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের জনগণকে এই মারাত্মক ভাইরাস থেকে রক্ষা করতে জানুয়ারী মাস থেকে কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে গণসচেতনতা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।”
অধ্যাপক আজাদ বলেন, করোনাভাইরাস রোগীদের জন্য ঢাকায় ছয়টি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রাজধানীর আরও পাঁচটি হাসপাতালে করোনভাইরাস রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা চলছে।
তিনি বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এ জাতীয় রোগীদের জন্য পৃথক বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
অধ্যাপক আজাদ বলেন, দেশে ব্যক্তিগত প্রোটেকটিভ সরঞ্জাম (পিপিই) এবং কিটসহ পর্যাপ্ত লজিস্টিক সরঞ্জাম রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ৪ লাখ ২৮ হাজার ৬০টি পিপিই সংগ্রহ করেছি। এগুলোর মধ্যে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬৫০টি পিপিই দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো এবং ৬৪ হাজার ৪১০টি মজুদ রাখা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা দুই ধরণের কোয়ারানটাইন ব্যবস্থা করেছি – একটি হলো হোম কোয়ারেনটাইন এবং অন্যটি হ’ল প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারোনটাইন। মোট ৬৪ হাজার, ৪৮৪ জনকে বাসা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। “এদের মধ্যে ২৪৮ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে, যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক আজাদ বলেছেন, এখন পর্যন্ত মোট ৪৮ হাজার ৩১ জনকে কোয়ারানটাইন থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। এখন আরও ১৬ হাজার ৪৫০ জনকে কোয়ারানটাইন করে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, “১৮ হাজার ৯০০ জনকে কোয়ারানটাইন করে রাখার জন্য ৩২৩টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করা হচ্ছে।
ডিজিএইচএস মহাপরিচালক জানান, কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঘটেছে কিনা তা দ্রুত নিশ্চিতকরণের জন্য ঢাকায় নয়টি সহ মোট ১৪ টি প্রতিষ্ঠান দেশে নমুনা পরীক্ষা চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য ঢাকায় নয়টি পলিমেরেস চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে, ঢাকার বাইরে এই ধরনের ল্যাবের সংখ্যা পাঁচটি।
অধ্যাপক আজাদ আরও বলেন, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই সকল বিভাগে কমপক্ষে একটি পিসিআর পরীক্ষাগার থাকবে এবং মাসের শেষে “আমরা সারা দেশে মোট ২৮ টি ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং পরিচালনা করার প্রত্যাশা করছি।”
এর আগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন যে, সরকার কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য ২০০টি আইসিইউ ইউনিট প্রস্তুত রেখেছে। । করোনভাইরাস নমুনা পরীক্ষার জন্য ১১ টি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, কোভিড -১৯ পরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য আমাদের প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে আরও ২৮ টি ল্যাব স্থাপন করা হবে।
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ডব্লিউএইচও কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে মালেক বলেন, ডব্লিউএইচও এবং জাতিসংঘ উভয়ই এই মারাত্মক রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশের উদ্যোগের প্রশংসা করেছে।
তিনি আরো বলেন, “চীনে করোনভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরে আমরা এই বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই দেশে এই রোগটি প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছি।”
মন্ত্রী বলেন, চিকিৎসা পেশাদারদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে, এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সহ প্রতিরোধমূলক সামগ্রী পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ রয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে সরকারী হাসপাতালে মোট ৫০০টি ভেন্টিলেটর রয়েছে, বেসরকারী হাসপাতালে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা ৭০০ এবং আমরা ল্যাব সুবিধা বিভাগীয় পর্যায়ে সম্প্রসারিত করেছি।
ডিজিএইচএস পরিচালক (তথ্য ব্যবস্থাপনা) ডাঃ হাবিবুর রহমান বলেছেন, সরকার দেশের আটটি জেলায় ৬ হাজার ২০০ বেড প্রস্তুত রেখেছে।
তিনি বলেন, দেশে ৯২,০০০ টেস্ট কিট রয়েছে, যার মধ্যে ২০,০০০ টি বিভিন্ন হাসপাতালে বিতরণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা বিচ্ছিন্ন রাখা এবং কোয়ারানটাইন ব্যবস্থা, পিপিই-র যথাযথ ব্যবহার, কোভিড -১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া সহ একটি ১৭-দফা স্বাস্থ্য নির্দেশিকা তৈরী করেছি।
ডাঃ রহমান বলেন, সরকার জনগণকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য ১২ হাজার ৪৪৮ জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে মেডিকেল পেশাদারদের একটি গ্রুপ গঠন করেছে।
“তারা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় জনগণকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এই জাতীয় চিকিৎসা পেশাদারদের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে” তিনি যোগ করেন।
ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদি সাব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরে সরকার বিভিন্ন কমিটি সমন্বিত করে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করেছে।
অধ্যাপক ফ্লোরা বলেন, “নিয়ন্ত্রণ কক্ষের অধীনে থাকা এই কমিটিগুলো এই রোগ থেকে রক্ষা করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা দিতে চব্বিশ ঘন্টা কাজ করে যাচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পাশাপাশি সরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে এবং মারাত্মক ভাইরাসের বিস্তার রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আরও একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে।
আইইডিসিআর পরিচালক বলেছেন, “দেশব্যাপী ব্যবস্থার অংশ হিসাবে, জনগণের স্বাস্থ্য সেবাগুলো নিশ্চিত করতে আমরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করেছি।”
“দেশব্যাপী ব্যবস্থার অংশ হিসাবে, জনগণের দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা লাভ নিশ্চিত করার জন্য আমরা জেলা পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করেছি।”
এদিকে, বাংলাদেশ আরো পাঁচজন নতুন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং করোনভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৬১ জনে দাঁড়িয়েছে। প্রাণহানির সংখ্যা ছয়।
ডিজিএইচএসে ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, “গত ২৪ ঘন্টার মধ্যে আরও পাঁচজনের দেহে কোভিড -১৯ সনাক্ত হয়েছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৬১ জনে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও জানান, ৬১ জনের মধ্যে এই রোগ থেকে নিরাময় হয়ে মোট ২৬ জন বাড়ি ফিরেছেন।
ওয়ার্ল্ডোমিটার প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, আজ ০৩ এপ্রিল পর্যন্ত কোভিড -১৯ প্রাদুর্ভাবে মোট ৫৪,১৯৮ জন মারা গেছে এবং ২০৪ টি দেশ ও ভূখ-ে বর্তমানে ১,০৩০,২০৫ জন আক্রান্ত হয়েছে।