ঘুমাও পিতা, আমরা জেগে রব তোমার আদর্শ বুকে নিয়ে : প্রধানমন্ত্রী

840

ঢাকা, ১৭ মার্চ ২০২০ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করে নিজেকে যোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, দেশের মানুষ তাঁর আদর্শ নিয়ে জাগ্রত থাকবে এবং তাঁর দেয়া পতাকাকে চিরকাল সমুন্বত রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তুমি ঘুমিয়ে আছ টুঙ্গিপাড়ার সবুজ ছায়াঘেরা মাটিতে পিতা মাতার কোলের কাছে। তুমি ঘুমাও পিতা শান্তিতে। তোমার বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাতে জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী এবং বছরব্যাপী মুজিববর্ষের কর্মসূচি উদ্বোধনকালে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে একথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা জেগে রইবো তোমার আদর্শ বুকে নিয়ে। জেগে থাকবে এদেশের মানুষ – প্রজন্মের পর প্রজন্ম – তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে। তোমার দেয়া পতাকা সমুন্নত থাকবে চিরদিন।’
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা কবিগুরুর একটি বিখ্যাত গানের পংক্তি তুলে ধরেন- ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি। তোমার সেবার মহৎ প্রয়াস সহিবারে দাও ভকতি।’
জাতির পিতার কন্যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘পিতা, তোমার কাছে আমাদের অঙ্গীকার, তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়বোই। সেদিন আর বেশি দূরে নয়।’
জাতির পিতার জন্মক্ষণের সঙ্গে মিল রেখে রাত ৮টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আতশবাজি পোড়ানোর মাধ্যমে শুরু হয় ‘মুক্তির মহানায়ক।’ জাতির পিতার জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন এবং মুজিববর্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। শত শিশুর কন্ঠে পরিবেশিত হয় জাতীয় সঙ্গীত। এরপরই রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা অনুষ্ঠানে তাঁর নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন। জাতির পিতাকে নিয়ে লেখা শেখ রেহানার কবিতা ‘বাবা’ আবৃত্তি করে শোনান শেখ হাসিনা।
যে কবিতার কয়েকটি পংক্তি হচ্ছে- ‘জন্মদিনে প্রতিবার একটি ফুল দিয়ে/শুভেচ্ছা জানানো ছিল/ আমার সবচেয়ে আনন্দ।/ আর কখনো পাবোনা এই সুখ/ আর কখনো বলতে পারবোনা/শুভ জন্মদিন।/’
শেখ হাসিনা বলেন,‘পিতা, ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিয়েছে তোমাকে। তোমার দেহ রক্তাক্ত করেছে। তোমার নাম বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওরা পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘ঘাতকেরা বুঝতে পারেনি তোমার রক্ত ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে-বেয়ে ছড়িয়ে গেছে সারা বাংলাদেশে। জন্ম দিয়েছে কোটি কোটি মুজিবের।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাই আজ জেগে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষ সত্যের অন্বেষণে। ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। আজ শুধু বাংলাদেশ নয় তোমার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনে নিয়েছে তোমার ত্যাগের মহিমায়।’
‘ধন্য মুজিব ধন্য,বাংলা মায়ের মুক্তি এলো এমন ছেলের জন্য,’ গানটিও শত শিশু সমবেত কন্ঠে পরিবেশন করে। কবি কামাল চৌধুরীর রচনায় এবং নকীব খানের সুরে দেশ বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে সমবেত সঙ্গীতে কন্ঠ মেলান জাতির পিতার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। শতযন্ত্রীর অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় যন্ত্র সঙ্গীত। শিল্পকলা একাডেমীর শিল্পীদের পরিবেশনায় নৃত্যনাট্য ‘চিত্রপটে দৃশ্যকাব্যে বঙ্গবন্ধু’ পরিবেশিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ওপর ‘ফাদার্স ভিশন অব দি ফ্লটিং ওয়ার্ল্ড’ গীতিনাট্য পরিবেশিত হয় এবং ‘জয় মুজিবের জয়, জয় বাংলার জয়’ গানটি সমবেত কন্ঠে পরিবেশনার মাধ্যমে লেজার লাইটের অনুপম প্রদর্শনীর মধ্যদিয়ে মুজিববর্ষের বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী পর্ব শেষ হয়। আতশবাজীর বর্ণিল আলোকচ্ছটায় রাতের আকাশে ভেসে ওঠে ‘শুভ জন্মদিন।’
ভূটানের রাজা জিগমে খেসার নমগেয়েল ওয়াংচুক, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভা-ারি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টনিও গুতেরাস এবং ওআইসি’র মহাসচিব ড. ইউসুফ আল ওথাইমিন’র জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে দেয়া ভিডিও বার্তা অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়।
বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা.আব্দুল আলিম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
আজ থেকে শতবর্ষ আগে ১৯২০ সালের ২০ মার্চ রাত ৮টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন খোকা। ঘটনাক্রমে সেই দিনটিও ছিল মঙ্গলবার। শেখ লুৎফর রহমান এবং সায়রা খাতুনের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
স্বদেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পরবর্তিতে যিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন এবং বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টি করেন। শুধু বাংলাদেশ নয় বন্ধুপ্রতিম দেশ, ইউনেস্কো, ওআইসি-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মুজিববর্ষ উদযাপিত হবে। ২৬ মার্চ ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপিত হবে। সেই দিন পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠানমালার মধ্যদিয়ে উদযাপিত হবে মুজিববর্ষ।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে দশর্ক সমাগম ছাড়াই ভিন্ন আঙ্গিকে মুজিববর্ষের উদ্বোধন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, জাতির পিতার নিজের জীবনের কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না। বাংলাদেশের মানুষকে উন্নত, সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর সে ত্যাগ বৃথা যায়নি।
তিনি বলেন, আজকে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন। আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। গড়তে হবে জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
নবীন প্রজন্মের কাছে প্রধানমন্ত্রী উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেন,‘আজকের শিশু-কিশোর, তরুণ সমাজের কাছে আমার আবেদন- তোমরা দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালবাসবে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলার উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে তোমাদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। ঠিক যেভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষকে ভালবেসেছিলেন, সেভাবেই ভালবাসতে হবে। তাঁর আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা আমাদের বাংলাদেশ নামের এই দেশটি উপহার দিয়ে গেছেন। বাঙালিকে দিয়েছেন একটি জাতি হিসেবে আত্মপরিচয়ের মর্যাদা। তাইতো তিনি আমাদের জাতির পিতা।
তিনি শিশুকাল থেকেই জাতির পিতার মধ্যে থাকা বিভিন্ন মানবিক গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘নিজের খাবারও তিনি ভাগ করে খেতেন। দুর্ভিক্ষের সময় গোলার ধান বিলিয়ে দিতেন। মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যেই তিনি আনন্দ পেতেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুঃখী মানুষকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে নিজের জীবনের সব সুখ-আরাম বিসর্জন দিয়ে জাতির পিতা আজীবন সংগ্রাম করেছেন। বারবার কারারুদ্ধ হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, মানুষের দুঃখ-কষ্ট জাতির পিতাকে ব্যথিত করতো। অধিকারহারা দুঃখী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে তিনি কখনও দ্বিধা করেননি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই বঙ্গভূমির বঙ্গ-সন্তানদের একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই তিনি বঙ্গবন্ধু।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সালের ২৬-এ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ উদযাপন করা হবে। আর ২০২১ সালে উদযাপিত হবে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বন্ধুপ্রতীম দেশসহ ইউনেস্কো, ওআইসি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মুজিববর্ষ উদযাপনে অংশীদার হয়েছে। এজন্য সকলকে তিনি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে। তবে, বছরব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে মুজিববর্ষ উদযাপিত হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ভূটানের রাজা জিগমে খেসার নমগেয়েল ওয়াংচুক, নেপালের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভা-ারি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি, জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টিনিও গুতেরাস এবং ওআইসি’র মহাসচিব ড. ইউসুফ আল ওথাইমিন-সহ বিদেশী শুভাকাক্সক্ষীদের মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভিডিও বার্তায় শুভেচ্ছা জানানোয় তাঁদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’
তিনি তাঁর নিজের এবং ছোট বোন শেখ রেহানার পক্ষ থেকে দেশের ভেতরে এবং বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের সকল নাগরিক এবং বিশ্ববাসীকে মুজিববর্ষের শুভেচ্ছা জানান।
তিনি এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চারনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সকল শহিদ এবং ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের শহীদ এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা মা-বোনদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
তিনি সরকারে থেকে মুজিববর্ষ উদযাপনের সুযোগ করে দেয়ায় দেশের জনগণের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ যে আমাদের জীবনে কত বড় পাওয়া, তা ভাষায় বুঝাতে পারব না। আমি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই দেশবাসীর প্রতি, যাঁরা আমার দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে, পরপর তিনবার সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে মুজিববর্ষ উদযাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন।’