রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করতে প্রধানমন্ত্রীর আহবান

791

ঢাকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করতে জার্মানীসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য এক বিরাট বোঝা এবং তারা সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। মিয়ানমারকে দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিয়ে যেতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ করে জার্মানীকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আরো ভূমিকা নেয়ার অনুরোধ করেন।
আজ বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে জার্মানীর সফররত অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. গার্ড মুলার সৌজন্য সাক্ষাতে এলে তিনি একথা বলেন। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার সাংবাদিকদের এ সম্পর্কে অবহিত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার আগমন কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের জন্য একটি বড় সমস্যার কারণ হয়েছে, কেননা তারা সংখ্যায় স্থানীয় জনগণকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, অনেকেই (রোহিঙ্গারা) নিজেদেরকে সন্ত্রাস এবং মানব পাচারে জড়িয়ে ফেলার সুযোগ নিচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ছাড়াও বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যাতে করে মিয়ানমার কতৃর্পক্ষ স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ থেকে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘এরপর মিয়ানমার আর রোহিঙ্গাদের ফেরত নিচ্ছে না এবং তারা চুক্তিও মানছে না’।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা পরিবারে নবীন সদস্য রয়েছে, যারা তাদের পিতা-মাতাকে হারিয়েছে‘ কাজেই খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা সন্ত্রাসে জড়াচ্ছে এবং মানব পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ছে। ‘তাদের এবং আমাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই আমরা রোহিঙ্গা শিবিরের চারপাশে বেড়া নির্মাণ করছি’।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের সকল প্রকারের সাহায্য প্রদান করছে। ঐ এলাকার নিরাপত্তার জন্য ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে।
জার্মান মন্ত্রী বলেন, তাঁর দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরো কিভাবে যুক্ত হতে এবং বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে তা বিবেচনা করবে। ড. মুলার প্রধানমন্ত্রীকে জানান তিনি আগামীকাল রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন। ‘আমি মনে করি তাদের নির্বাচনের পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী এবং জার্মান মন্ত্রী বৈঠকে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন। এরমধ্যে রয়েছে- জার্মান বিনিয়োগ, তৈরি পোশাক শিল্প, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়ন, পানি শোধন প্রকল্প এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিষয়।
বাংলাদেশে তার দেশের বিনিয়োগ প্রসঙ্গে যখন জার্মান মন্ত্রী বলছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার সারাদেশে একশ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে।
‘জার্মানী চাইলে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য জমি বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে,। এ সময় তিনি জার্মান বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগেরও আহবান জানান।
ড. মুলার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকল গার্মেন্টস কারখানা আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ২২১ শতাংশ বাড়িয়েছে এবং শিল্প মালিকদের বুঝিয়ে তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করেছে।
সরকার গঠনের সময় অধিকাংশ গার্মেন্টস শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১৬শ’ টাকা ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আমরা তা বাড়িয়ে ৮ হাজার ৩শ’ টাকা করেছি।’
সরকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং আবাসিক হোস্টেল সুবিধা প্রদান করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশী গার্মেন্টস পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্যও ক্রেতাদের আহবান জানিয়ে বলেন, ‘যদিও আমরা উল্লেখযোগ্য হারে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়েছি তথাপি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের গার্মেন্টস পণ্যের দাম পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ক্রেতা হিসেবে আপনাদেরকেও ভাবতে হবে আপনারা কত দিচ্ছেন’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্র বিবেচনা করে জনগণের আরো কর্মসংস্থানের জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের সকল উপজেলায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছি, যাতে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা লাভ করতে পারে।’
জার্মান মন্ত্রী বলেন, তারা ৫শ’ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মেঘনা ঘাটে একটি পানি পরিশোধন প্রকল্প বসানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, যাতে দক্ষিণ পূর্ব ঢাকাবাসী বিশুদ্ধ পানি পেতে পারে। প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন কামনা করেন।
প্রকল্পটি যাতে দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন হয়, বিষয়টি দেখবেন বলেও জার্মান মন্ত্রীকে আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনকালে জার্মান চ্যান্সেলরকে বাংলাদেশ সফরের আহবান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই সে সময় বাংলাদেশ সফরের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।’ আগামী নভেম্বরে জার্মান চ্যান্সেলর অবসরে যাবেন বলেও জার্মানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তার (চ্যান্সেলর) অবসরের আগেই মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং এখানকার রোহিঙ্গা ইস্যু দেখার জন্য তার অবশ্যই বাংলাদেশ সফর করা উচিত।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সর্বাত্মকরণে বিষয়টি দেখবার জন্যও জার্মান মন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান। এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূতের প্রতিও আহবান জানান।
শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের সময়ে দেশের উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কেও জার্মান মন্ত্রীকে অবহিত করেন। তিনি পাসপোর্ট, ই-পাসপোর্ট এবং অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশে জার্মানীর অর্থনৈতিক সহযোগিতাও উল্লেখ করেন।
বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সে সব অঞ্চলে প্রায় ৫৫ লাখ সোলার প্যানেল স্থাপন করেছি।’
ড. মুলার প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের ভুয়শী প্রশংসা করে বলেন, ‘আপনি আপনার দেশে আপনার বাবার মতই ব্যাপক জনপ্রিয়।’
বৈঠকের শুরুতে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের মাধ্যমে চতুর্থবারের মত পুনঃনির্বাচিত হয়ে প্রধানন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করায় জার্মানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান।
তিনি মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ও বাংলাদেশের জনগণ এবং প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, ডিরেক্টর জেনারেল অব হেড অব মিডিলইষ্ট,এশিয়া,সাউথ-ইস্ট এন্ড ইউরোপ দি মিনিষ্ট্রি অব ইকোমনিক কো-অপারেশন ইন জার্মানী ড. ক্লদিয়া ওয়ার্নিং এবং ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার ফরনহোল্টজ এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।