গুলজান বেগমের সাফল্য এসেছে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সাহায্যে হাঁসের খামার করে

328

পঞ্চগড়, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০(বাসস): জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদীঘি ইউনিয়নের মল্লিকাদহ শাহাপাড়া গ্রামের বেকার নুর হোসেনের স্ত্রী গুলজান বেগম। গুলজান বেগমের সংসারে সাফল্য এসেছে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সদস্য হয়ে লোন নিয়ে হাঁসের খামার করে। ইতোপূর্বে গুলজান বেগম গরীব ছিল, তার পরিবার চালাতে সে ছিল অক্ষম। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাঝে মধ্যে গুলজান বেগমের দিন অতিবাহিত হতো অর্ধাহারে। গুলজান ছিল কর্মঠ ও উদ্যমশীল। তার আপ্রাণ প্রচেষ্টা ছিল অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।
গুলজান বেগম জানান, বসতভিটা ছাড়া তার আর কোন জমি নেই। এক মেয়ে এক ছেলেসহ ৪ জনের সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে আমি অন্যের জমিতে কাজ করতাম। প্রতিদিন কাজ পেতাম না। এ উর্পাজন দিয়ে সংসার চলতো না ভালভাবে। মাসখানেক এ ভাবে চলতে চলতে আত্বীয়ের মাধ্যমে জানতে পারি আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের কথা। এ প্রকল্পে সমিতির মাধ্যমে সদস্য হওয়া যায় । গুলজান বেগম ২০১৭ সালে সমিতির সদস্য হয় এবং সঞ্চয় জমা করে। এক বছর সঞ্চয় জমা করার পর জমাকৃত সঞ্চয়ের সমপরিমান টাকা প্রকল্প থেকে লোন হিসেবে গুলজান বেগম নেন ৯ হাজার টাকা। গুলজান বেগম সিদ্ধান্ত নেন লোনের টাকা দিয়ে বাড়িতে হাঁসের খামার করার। প্রথম বার সে ১৫০টি হাঁস দিয়ে খামার শুরু করে। মাস দুয়েক পর হাঁস থেকে ডিম বিক্রি শুরু করে। প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০টি ডিম বিক্রি করে।
ডিম বিক্রির টাকা দিয়ে সমিতিতে নিয়মিত সঞ্চয় দেয়। প্রথম বারের লোনের টাকা পরিশোধ করার পর দ্বিতীয় দফায় গুলজান বেগম সমিতি থেকে ১৬ হাজার টাকা লোন গ্রহণ করে। এ টাকা দিয়ে সে নওগা থেকে বেইজিং জাতের ২শ হাঁসের বাচ্চা কিনে আনে। প্রতিটি বাচ্চা ৫০ টাকা দরে কিনে। তিন মাস পর প্রতিটি হাঁস ৪শ থেকে ৫শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে। হাঁস বিক্রি করে গুলজান বেগম ৯০ হাজার টাকা পায়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের লোন পরিশোধ করার পর গুলজান বেগম তৃতীয় দফায় সমিতি থেকে আরও ২২ হাজার টাকা লোন নেয়। এ টাকাও হাঁসের খামারে লাগায়। এখন তার খামারে ৪শ বেইজিং জাতের হাঁসের বাচ্চা ও দেশী হাঁস ৩শ রয়েছে। দেশী হাঁস থেকে প্রতিদিন গুলজান প্রায় ২শ ডিম পাচ্ছে। সামনের দু মাস পর গুলজান বেগম হাঁস বিক্রি করে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় করতে পারবে এবং ডিম থেকে প্রতিদিন আয় আসছে ১৫০০ টাকা। মাসে ৩৫ হাজার টাকা । তিন মাস নিয়মিত ডিম বিক্রি করে আয় এসেছে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। গুলজান বেগম আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সমিতি থেকে ৯ হাজার টাকা লোন নিয়ে হাঁসের খামার শুরু করে আজ তার খামারে ৭শ হাঁস হয়েছে। হাঁসের খামার থেকে উর্পাজিত অর্থ পেয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। এ টাকা দিয়ে ৩ বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছে। গুলজানের সংসারে এখন সুখ, নেই কোন অভাব। গুলজানের ছেলেটি লেখাপড়া করছে। মেয়েকে কিছুদিন আগে অপেক্ষাকৃত ভাল জায়গায় বিয়েও দিয়েছিল,তবে বিয়ের কিছুদিন পর সড়ক দুূর্ঘটনায় মেয়েটি মারা যায়। গুলজান বেগম এখন স্বাবলম্বী। এখন আর তাকে সংসারের আভাব অনটন নিয়ে ভাবতে হয় না। সমিতিতে আমার সঞ্চয় আছে প্রায় ১৪ হাজা টাকা। গুলজানের মতো ওই সমিতির অন্য সদস্য আফছানা আক্তার মিনিও হাঁসের খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছে। গরুর খামার, তেজপাতার বাগান করে স্বাবলম্বী হয়েছে আলী হোসেন, অছিমন নেছাও।
একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের দেবিগঞ্জ উপজেলা সমন্বয়নকারী আশরাফুল আলম বলেন, এ প্রকল্পের একটি লক্ষ্য আছে। এ লক্ষ্য হলো মানুষ ও সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করা। এ উপজেলায় ১০ ইউনিয়নে ২৭৬টি সমিতি রয়েছে। ৬০ জন সদস্য নিয়ে একটি সমিতি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ জন নারী ও ২০ পুরুষ। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সদস্যদের অবস্থা বিবেচনা করে গরু, হাঁস-মুরগী, মাছ, ,গবাদি পশু পালন, ক্ষুদ্র, কুটির শিল্প, মৃৎ শিল্প , নার্সারি ,শাক সবজি চাষের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকল্পের আরেকটি মূল উদ্দেশ্য মানুষকে সঞ্চয়মুখী করা। ১টি সমিতিতে ২ বছরে প্রায় ৯ লাখ টাকা জমা হয়। প্রত্যেক সদস্য ২০০ টাকা সমিতির হিসাবে জমা দেন। সরকারও সঞ্চয় দেন প্রত্যেক সদস্যকে ২০০ টাকা করে। এভাবে ৬০ জনের ২ বছরে জমা হয় দুই লাখ ৮৮ হাজার টাকা। সরকারের দেয়া সঞ্চয়ও ২ লাখ ৮৮ হাজার । এছাড়া সরকারের লোন তহবিল সমিতিতে দেয় ৩ লাখ টাকা। সব মিলে দুই বছরে হবে প্রায় নয় লাখ টাকা। এটা সম্পূর্ণ সমিতির সদস্যদের টাকা। এরপর সমিতির সদস্যরা উঠান বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ, সঞ্চয়, পুজি সৃষ্টি ,অনলাইন ব্যাংকিং ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে এ সমিতির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা একটি নিরাপদ আর্থিক কাঠামো পাচ্ছেন। এর মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র মানুষ একটি সমৃদ্ধ জীবন গড়তে পারবেন। এ বছর দেবীগঞ্জ উপজেলায় ১০ ইউনিয়নে উপকারভোগীর সংখ্যা ১৬,৫৬০ জন। ক্ষুদ্র উদোক্তা লোন দেয়া হয় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। সুদের হার ৫ শতাংশ। শুরু থেকে এখ পর্যন্ত লোন বিতরণ হয়েছে ২৫ কোটি ৭৯ লাখ ৮৭ হাজা টাকা। আদায়ের পরিমান প্রায় শতভাগ। তারা সঠিক সময়ে টাকা জমা দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে যে সহায়তা,বোনাস পাওয়ার কথা ছিল, তাও সঠিক সময়ে পেয়েছে। এ টাকায় যারা লোন পেয়েছিলেন তারা উপকৃত হয়েছেন। এ প্রকল্প ৬০ শতাংশ পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের আওতায় এসেছে।
দেবীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রত্যয় হাসান জানান, দেবীগঞ্জ উপজেলায় একটি বাড়ি একটি খামার বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। আমি সমিতির সভাপতি হিসেবে মাসিক সভা করে সদস্যদের সমস্যা শুনে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি লোনের টাকা যথাযথ ব্যবহার হওয়ার মনিটরিং করি। দেবীগঞ্জকে ভিক্ষুক মুক্ত করার জন্য সমিতির ৬০ জন মেম্বারদের সমন্বয়ে কোন গ্রামে ভিক্ষুক থাকলে তাকে একটি বাড়ি একটি খামার সমিতির সদস্য করে লোন দেওয়ার মাধ্যমে ভিক্ষুক মুক্ত দেবীগঞ্জ গড়ার জন্য উদ্যোগ অব্যাহত আছে। মাসিক সভায় সদস্যদের গাভী পালন ও হাঁস-মুরগী পালনে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া গরু, হাঁস-মুরগীর ওষুধ দেখা দিলে চিকিৎসাও প্রাণী সম্পদ বিভাগ করে থাকে। এভাবে সমিতির উন্নয়নে সদস্যদের এগিয়ে নেয়ার কাজ করি। আমি বিশেষভাবে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প গুরত্ব দিয়ে আমার নিকট অর্পিত দায়িত্ব পালন করে আসছি, ফলে এ প্রকল্পের সদস্যরা লোন নিয়ে বেশ উন্নতী করেছে। তারা নিয়মিত লোন পরিশোধ করছে এবং নতুন লোন গ্রহণ করছে। এক্ষেত্রে তাদের কোন প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে না।