খুশির ছোঁয়ায় অসহায় নারীর ভাগ্য বদল

2085

ঢাকা, ১৮  ফেব্রুয়ারি, ২০২০ (বাসস) : খুরশীদা বেগম খুশি এখন জামালপুরের একটি পরিচিত নাম। পঁয়তাল্লিশ  বছর বয়সী এই নারী এখন নিজ এলাকায় সমাজের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সামনে এক উদাহরণ। নিজেই যেমন করেছেন নিজের কর্মসংস্থান, তেমনি সুযোগ করে দিয়েছেন এলাকার আরো বেশ কিছু মানুষের কর্মের জোগান। এখন তিনি তমালতলা এলাকায় ‘খুশি বস্ত্রলায়ের’ স্বত্বাধিকারী। হয়েছেন স্বাবলম্বী। সব খরচ বাদ দিয়ে তার মাসিক আয় প্রায় ২৫ হাজার টাকা।
অথচ এক সময় তাকে সংসারের নিত্যদিনের খরচ যোগাতেই হিমশিম খেতে হত। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা খুশি খুব বেশি পড়ালেখা করতে পারেনি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্কুল বাদ দিয়ে তাকে বিয়ে দেন তার পরিবার।
বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে দুই সন্তানের মা হন খুশি। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তার মুদি দোকানদার স্বামীর একার পক্ষে সংসারের সব খরচ চালাতে হিমশিম থেতে হয়। নুন আনতে যখন পান্তা ফুরায় তখনই খুশি সিদ্ধান্ত নেয় কিছু একটা করতে হবে। নয়তো আজীবন এভাবেই অভাবের সাথে সমঝোতা করে চলতে হবে। তার দুই সন্তানের ভবিষ্যৎও অন্ধকার। টাকা না থাকলে তাদেরও স্কুল থেকে নাম বাদ দিয়ে দিতে হবে।
এমন ভাবনা থেকেই তিনি স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর দোকানে শিÿানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ২৫ বছর আগে হঠাৎ একদিন আমার পাশের বাড়ির ভাবী আমাকে ওখানে কাজ করতে বলেন। তার কথামত সেখানে গিয়ে দেখি আমার মত অনেক নারীই সেখানে নকশী কাঁথার এ্যাম্ব্রয়ডারী করছেন। তাদের এ কাজ দেখে আমিও ঠিক করে ফেলি এই কাজ শিখতে হবে।
তিনি বলেন, শুরুর দিকে আমি শুধু কাজই করতাম। বাড়ীতেও যখন সুযোগ পেতাম তখনও আমি কাজ করতাম। এ যেন এক নেশা। আমার বয়স যখন মাত্র ২০ বছর তখন আমি স্থানীয় ‘সৃজন হ¯Íশিল্প’- নামের একটি দোকানে এ কাজ নিই। সেখানে মাসিক বেতন ছিল মাত্র ৫০০ টাকা। কাজ করতে হতো ১২ ঘন্টা। যদিও টাকাটা খুব কম ছিল তারপরও আমি করে গেছি শুধুমাত্র কাজ শেখার আগ্রহে। সেখান থেকে আমি অনেক কিছুই শিখতে পেরেছি। কম্বল, বেড শীট, বালিশের কভার, শাড়ি এবং মেয়েদের অন্যান্য কাপড়ে এ্যামব্রয়ডারী করতে হয় তা শিখেছি।
খুশি বলেন, ‘আমার কাজ এবং কাজের প্রতি আগ্রহ দেখে মালিক আমার বেতন দেড় হাজার টাকা করে দেন মাত্র দুই মাস পরে। এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমারও এমন একটি প্রতিষ্ঠান হবে। আমিও উদ্যোক্তা হব।’
সেখানে তিন বছর কাজ করার পর তিনি কাজ শুরু করেন আরেক হ্যান্ডিক্রাফট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘শতদল’-এ। এখানে বেতন ছিল তিন হাজার টাকা। এরমধ্যে খুশির নিজেরও বেশ কয়েকজন ঢাকার ব্যবসায়ীর সাথে যোগাযোগ হয়। মূলত তার স্বামীর সূত্র ধরেই তাদের সাথে পরিচয়।
খুশি বলেন,‘ আমি তাদেরকে নিজের করা কিছু কাজ দিই। আর এভাবেই আমি চাকরীর পাশাপাশি নিজে ব্যবসা শুরু করি।’
তিনি বলেন, সেখানে পাঁচ বছর কাজ করার পর আমি আরো নতুন নতুন কাজ শেখার সুযোগ পাই। অবশেষে ২০১৩ সালে আমি আমার চাকরী ছেড়ে দিই এবং নিজের ব্যবসা শুরু করি। সে সময় অল্প পরিসরে নিজের বাড়িতেই বিশ হাজার টাকা খরচ করে শুরু করি আমার নিজের প্রতিষ্ঠান ‘খুশি হ¯Íশিল্প’। এ সময় স্থানীয় যেসব নারীরা এ কাজে অভিজ্ঞ তাদের কাজে নিয়োগ দিই। এছাড়াও কয়েকজন নারী কর্মী নিয়োগ দিই সুপারভাইজার হিসেবে।
তার প্রতিষ্ঠান থেকে মূলত নকশী কাঁথা, বেড শীট, কুশন কাভার, ওয়াল ম্যাট এবং মেয়েদের কাপড়ে এ্যাম্ব্রয়ডারীরর কাজ করা হয়। আর তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী কর্মীদের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে তাদের কাজের দÿতা অনুসারে।
খুশি বলেন, গত এক যুগে সে এই ব্যবসা থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ টাকা সঞ্চয় করেছে। আর এ সঞ্চয়ের অধিকাংশ টাকাই তার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জামালপুর হ্যান্ডিক্রাফট এন্টাপ্রেণার এসোসিয়েশনের সদস্য মাকসুদা হাসনাত বলেন, খুশি এখন এই অঞ্চলে একজন উদাহরণ, যিনি নিজেই নিজের ভাগ্য বদল করেছেন। আবার এলাকার অনেক নারীর ভাগ্য বদল করেছেন তিনি।