ছাত্রলীগকে মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

1605

ঢাকা, ৪ জানুয়ারি, ২০২০ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীতি ও আদর্শ নিয়ে চলার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের পাশপাশি ছাত্রলীগকে একটি মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা এর সকল নেতা-কর্মীকে মনে রাখতে হবে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা, ঐতিহাসিক ৬ দফা, ১১ দফা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে তাদের আচার-আচরণ, তাদের কথা-বার্তা, তাদের রাজনীতি-সবকিছু সেইভাবেই করা উচিত। যেন এই সংগঠনটা একটা মর্যাদাপূর্ণ হয় এবং দেশ ও জাতির কাছে যেন তারা একটা আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে চলতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আজ বিকেলে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও পুনর্মিলনী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির যে কোন ক্রান্তিলগ্নে ছাত্রলীগ সবসময় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। আমার বাবা-যখন জেলে থাকতেন তখন ছাত্রলীগ যোগাযোগ রাখতো আমার মায়ের সঙ্গে এবং তিনিই সবসময় ছাত্রলীগকে নির্দেশনা দিতেন এবং সেই নির্দেশনা মোতাবেকই ছাত্রলীগ কাজ করতো।
তিনি বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে একটি সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের যে ঐতিহ্য, যে অবদান এটা প্রতিটা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর মনে রাখা উচিত।’


এরআগে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে ’৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। এ সময় সমবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত এবং পরে ছাত্রলীগের দলীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চারনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সকল শহিদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবসহ ১৫ আগস্টের শহিদগণ এবং সকল গণঅন্দোলনে আত্মাহুতিদানকারি ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ এবং এর সকল সহযোগী সংগঠনের আত্মাহুতিদানকারীদের স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এর পরেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক উপ-কমিটির পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ছোটবেলায় দেখা এদেশের রাজনীতির উদাহারণ টেনে বলেন, ‘আইয়ুব খান ‘মার্শাল ল’ দিয়ে ক্ষমতা দখল করে প্রেসিডেন্ট হলো। আগে ক্ষমতা দখল, তারপর দলগঠন এবং তারপরে ছাত্র সংগঠনের কিছু ছেলেদের হাতে অস্ত্র দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের একটা অবস্থান নেওয়ার অপচেষ্টা।’
তিনি বলেন, ‘তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ’৭৫ এর জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করে যখন জিয়াউর রহমান আসে তখনও দেখি তার একই চরিত্র। ঠিক আইয়ুব খানের পদাংক অনুসরণ করে তিনি মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র ও অর্থ তুলে দিয়ে তাদের ব্যবহার করতেন একটা লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে। অবৈধভাবে দখলকরা ক্ষমতাকে বৈধ করার একটা হাতিয়ার হিসেবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, এভাবে বহু মেধাবী ছাত্রের জীবন তারা নষ্ট করেছে। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদরদের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের রাজনীতি করার অধিকার দেওয়ার পাশাপাশি ৭ খুনের আসামীকেও রাজনীতি করতে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি তোফায়েল আহমেদ এমপি, দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের পক্ষ থেকে খালেদ মোহাম্মদ আলী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকবৃন্দ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় অনুষ্ঠানে সভাপত্বি করেন। দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে পরিচয় করিয়ে দেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সারাদেশ থেকে আগত ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকবৃন্দ এবং বিশিষ্ট নাগরিকসহ আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদককে পূর্ণকালিন দায়িত্ব ও প্রদান করেন।
বাংলা, বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের লক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন।

জাতির পিতার বক্তব্য ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস’ উদ্বৃত করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, এই ছাত্রলীগ ১৯৭৫ সালের পর প্রথম যে প্রতিবাদটা, সেটাও ছাত্রলীগের কিছু ছেলে এবং সেই সাথে ছাত্র ইউনিয়ন সহ অন্যান্য সংগঠন মিলেই করেছিল।
সে সময়ে ‘তাঁর রিফিউজি জীবন যাপনকালিন তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রথম দাবিটাও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই হয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেময়কার যুবলীগ নেতৃবৃন্দ এবং মিজানুর রহমান চৌধুরী সংসদে দাঁড়িয়ে দাবি তোলেন, বলেও জানান।
’৭৫ এর পর ষড়যন্ত্রকারী ভেবেছিল আওয়ামী লীগ আর কোনদিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেই আওয়ামী লীগ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে আবার সরকার গঠন করেছে।’
সেজন্য ছাত্রলীগকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন,‘আমি এটাই চাই আগামী দিনে এই ছাত্রলীগ যেন একটা নীতি আদর্শ নিয়ে চলে। জাতির পিতা যে লক্ষ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করেন সেই ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত করেই বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। আর আমরা যে তা পারি সেটা সরকারে আসার পরেই আমরা প্রমাণ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন আগামীর নেতৃত্ব যেন এই একটি আদর্শ ভিত্তিক সংগঠনের মধ্যদিয়েই যেন চলে আসে সেটা ছাত্রলীগকে মনে রাখতে হবে। এই সংগঠনটার মধ্যদিয়েই যেন আগামীদিনের নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে।’
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ছাত্রলীগের হাতে তিনি কাগজ-কলম তুলে দিয়েছিলেন। আর খালেদা জিয়া তুলে দিয়েছিল অস্ত্র।
তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি কম্পিউটার দিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই প্রথম কম্পিউটার প্রশিক্ষণ শুরু করেন। আজ যে ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছি সেখানে ছাত্রলীগের অনেক অবদান রয়েছে।
শেখ হাসিনা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামক বঙ্গবন্ধুর লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ দুটি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মনযোগ দিয়ে পাঠ করার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান ইন্টালিজেন্স রিপোর্ট নিয়ে প্রকাশিতব্য (সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ১৪ খন্ডের ভলিউমটি দেশের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য প্রত্যেকটি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর অবশ্য পাঠ্য হিসেবেও উল্লেখ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র থাকার সময়ই জাতির পিতার ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং কারাগারে যাওয়া। ঢাবি’র ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারিদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার হওয়া। মুচলেখা দিয়ে ছাত্রত্ব গ্রহণের সুযোগ থাকলেও অনিয়মের সংগে আপস না করার মত দৃঢ়চেতা মনভাবের অনেক ঘটনার বিস্তারিতও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা এখান থেকে জানতে পারবে, উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, পাকিস্তানীরা শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলতে বাধা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা ফরমান জারি করেছিল যে, বাংলা অক্ষর পরিবর্তন করে আরবি হরফে বাংলা ভাষা লিখতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এর বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম ছিল তা ছাত্রলীগকে দিয়েই শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। এরপর যে সংগ্রাম হয়েছে সেখানে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।’
তিনি বলেন, ১৯৫৮ সালে যখন মার্শাল ল’ দেয়া হলো তখন বঙ্গবন্ধু কারাগারে থেকেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যেভাবেই হোক এই বাংলাকে মুক্ত করতে হবে, স্বাধীন করতে হবে। ১৯৬০ সালে বঙ্গবন্ধু যখন জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন তখন শুধু রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল তা নয়, তখন তার ঢাকার বাইরে যাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। তখন তিনি ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করার নির্দেশনা দিয়ে পদক্ষেপ নেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সেই লক্ষ্যে জাতির পিতা পুরো বাংলাদেশে ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। প্রত্যেক জেলা এবং ইউনিয়নে দু-তিন সদস্যবিশিষ্ট একটা নিউক্লিয়াস গঠন করে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে মানুষের মাঝে চেতনা তৈরি করে জনগণকে সেটা গ্রহণ করানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন ছাত্রলীগকে।