মায়ের বুকের দুধ শিশুর আদর্শ খাবার

1562

ঢাকা, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : মায়ের দুধ শিশুর অধিকার। জন্মের পর একটি শিশুর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে পুষ্টি দরকার তার সবই আছে মায়ের দুধে। তাই মায়ের বুকের দুধই শিশুর শ্রেষ্ঠ খাবার। শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দৈহিক গঠনে মায়ের দুধের অপরিহার্যতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণের মতে, অন্য যে কোন বিকল্প দুধের চেয়ে মায়ের দুধের পুষ্টিগণ বহুলাংশে বেশি। পরিমিত প্রোটিন, ভিটামিন ও রোগ প্রতিরোধ উপাদানের সংমিশ্রণে বুকের দুধ শিশুর জন্য সবচেয়ে আদর্শ খাবার। মায়ের বুকের দুধে ল্যাকটোজ নামক এক বিশেষ ধরনের শর্করা আছে, যা শিশুর শরীরের ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণ করে।
মায়ের দুধ শিশুর জন্য আল্লাহর আশির্বাদ। শিশুর প্রথম পুষ্টির যোগানও আসে মাতৃদুগ্ধ থেকে। শিশু জন্মের পর মায়ের বুকে প্রথম যে দুধ আসে সেটাকে শাল দুধ বলা হয়। শাল দুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালী প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। এর ফলে শিশুর শরীরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ অন্যান্য রোগ জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। এন্টিবডিতে পূর্ণ শালদুধ শিশুর বুক ও কানের প্রদাহ, ডায়রিয়া, এ্যাজমা, একজিমা ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করে এবং শিশুর দাঁত ও হাড় মজবুত রাখে। জন্মের পর শিশুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। একজন নিকটাত্মীয় বা একজন নার্স এ ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন। নবজাতক ও মাকে একই বিছানায় থাকতে দিতে হবে, যাতে শিশু তার মায়ের সান্নিধ্য পায়। মায়ের পর্যাপ্ত দুধ আসার জন্য অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশি পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। কারণ শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সব কিছুই মায়ের দুধে আছে।
শিশুকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এ সময় অন্য কোন খাবার এমনকি পানিও দেয়ার প্রয়োজন নেই। ছয় মাস পেরিয়ে গেলে দু’বছর পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার খাওয়াতে হবে। যেমন- সবজি দিয়ে খিচুড়ি, ডিম, মাছ, মাংস ও বিভিন্ন ধরনের ফলমূল শিশুর চাহিদা মতো খাওয়াতে হবে।
জন্ম থেকে প্রথম ছয় মাস যে শিশুরা শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করে, তাদের জীবরে হয় শ্রেষ্ঠ সূচনা। শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করলে শিশুরা পায় সঠিক পুষ্টি ও মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য সব ধরনের পুষ্টি উপকরণ। শিমুরা পায় শ্রেষ্ঠ সুরক্ষা। শ্বাসনালী সংক্রমণ, ডায়রিয়া ও অন্যান্য জীবনঘাতী রোগ থেকে রক্ষা পায়। শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করালে মা ও শিশু উভয়েই উপকৃত হয়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট হেলথ-এর গবেষণায় দেখা গেছে, স্তন্যদানকারী মা প্রসব পরবর্তী বিষণœতায় কম ভোগেন। জন্মের পরই শিশুকে বুকের দুধ দিলে শরীর থেকে অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়। এই অক্সিটোসিন জরায় এবং এর রক্তনালীকে সংকুচিত করতে সাহায্য করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জন্মের পর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের স্তন ক্যান্সারের আশঙ্কা ২৫ শতাংশ কমে আর জরায়ু ক্যান্সারের আশঙ্কা ৩ থেকে ৬০ শতাংশ কমে যায়। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর ১ থেকে ৭ আগস্ট পালিত হয় বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। ১৯৯৩ সালে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহে মাতৃবান্ধব কর্মস্থল সৃষ্টির উদ্যোগের যে অভিযান শুরু হয়েছিল একনও তা অব্যাহত আছে। সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থল, হাসপাতাল, শপিংমল ও বিনামবন্দরের মতো জনাকীর্ণ স্থলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের জন্য সম্প্রতি হাইকোর্ট রুল জারি করেছে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ ও সবল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিশুর মাতৃদুগ্ধপান করাতে উদ্বুদ্ধকরণ ও এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা, মায়েদের কর্মস্থল ও ঘরের বাইরেও শিশুকে বুকের দুধ পানের জন্য অবাধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে।
জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুকে শুধু মায়ের দুধ পান করাতে হবে- এ বিষয় নিয়ে সরকার, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ আরও অনেক শিশুবান্ধব আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রচার প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাতৃদুগ্ধপানের হার পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়েছে। দেশে প্রায় ৬৪ শতাংশ শিশু মায়ের বুকের দুধ পান করে থাকে। মাতৃদুগ্ধপানের হিতকারী ফল অপরিসীম। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মায়ের বুকের দুধের সব ধরনের বিকল্পের বিজ্ঞাপন ও বিপণন সীমিত করতে হবে এবং বিপণনের আন্তর্জাতিক বিধির মনিটরিং ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের সুস্থ শিশু ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকল শিশুকে মায়ের দুধ পান করানো ও ঘরে তৈরি পরিপূরক খাবার খাওয়ানোর হার বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সাথে গুঁড়াদুধ বা কৌটাজাত শিশুখাদ্যের ব্যবহার ও বিজ্ঞাপন সর্বনি¤œ পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার গুঁড়া দুধের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে মায়ের দুধের পক্ষে সচেতনতা তৈরিতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মায়ের বুকের দুধ শিশুর অমৃত, সঞ্জীবনী। শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর জন্য মাকে পরিবারের সবাই মিলে সহযোগিতা করতে হবে।