সঠিক পুষ্টির জন্য সবার প্রয়োজন সুষম খাবার

1514

ঢাকা, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : শেরপুর জেলার পাশ দিয়ে বয়ে চলছে ব্রহ্মপুত্র নদ। তার পাশেই গড়ে উঠেছে ছোট্ট পার্ক। সেখানে ফুসকা আর চটপটির দোকানে কাজ করে একটি মেয়ে। বয়স আনুমানিক ১৪/১৫ বছর। নাম জিজ্ঞাসা করতেই হেসে উত্তর দেয় ‘আয়না’। গ্রীষ্মের প্রখর রোদ যেন চোখে মুখে পড়ছে। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে সে। কাপড় দিয়ে কয়েকবার ঘাম মুছে নিল নিজের অজান্তে। আবার কাজ করতে লাগল।
আয়না জানালো, সে পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। বাবা ভ্যান রিক্সা চালিয়ে যে আয় করে তা দিয়ে তাদের সংসারের খরচ চলে না। তাই, লেখাপড়া বন্ধ করে চটপটির দোকানে কাজ নিয়েছে। সামান্য আয় করে তা সন্ধ্যার পরে তুলে দেয় মায়ের হাতে। আয়নার বড় ইচ্ছা ছিল, একদিন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় অফিসে চাকরি করবে, বাবা-মা আর ভাই-বোনদের মুখে হাসি ফুটাবে। কিন্তু বাস্তবতার কাছে হার মেনে নিজেকে এখন মানিয়ে নিয়েছে এই কাজের সাথে। কিন্তু, অপুষ্টি রয়েছে তার শরীরে, ক্লান্তির চিহ্নও বেশ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। আমাদের চারপাশে আয়নার মত এমন অসংখ্য শিশু রয়েছে, যারা অপুষ্টির শিকার।
অপুষ্টির প্রধান কারণ হচ্ছে, অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্র, পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। অধিক জনসংখ্যা যে দেশে, সেখানে পরিবেশ দুষিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ, অল্প জায়গার মধ্যে অনেক লোকের বসবাসের ফলে নোংরা পানি, আবর্জনায় ভরপুর পথঘাট স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। এ ছাড়া অধিক জনসংখ্যার কারণে খাদ্যদ্রব্যের সহজলভ্যতাও কমে যায়। ফলে, কিশোর কিশোরীরা স্বাভাবিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। আর্থিক কারণেও প্রয়োজনীয় খাবার খেতে না পারায় অপুষ্টির শিকার হয়। আবার যে পরিবারে অর্থের সমস্যা নেই, সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরাও অতিরিক্ত পরিমানে জাঙ্কফুড খাওয়ায় অপুষ্টির শিকার হতে পারে।
পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতা, যেমন- বয়স অনুপাতে কতটুকু খাবার, কি খাবার, কত সময় পর পর খেতে হবে, তা অনেক মা-বাবাই জানেন না। এখানে সুষম খাবারের ঘাটতি দেখা যায়। অপুষ্টি দুর করতে হলে সুষম খাবার খেতে হবে। এটা শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, সব বয়সের মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ^ খাদ্য কর্মসুচি (ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে ’বাংলাদেশের খাদ্য ঘাটতি পুরণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। এতে পুষ্টি সমস্যা কমিয়ে আনায় বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরা হয়। অপুষ্টির কারণে ১৯৯৭ সালে যেখানে দেশের ৬০ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতি ছিল, ২০১৮ সালে তা কমিয়ে ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে। গত ২১ বছরে খর্বাকৃতি সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে, খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা এখনো বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি। পুষ্টিকর খাবার বলতে অনেকে পাউরুটি, বার্গার ও মিষ্টিকে বুঝে থাকে। এর ফলে পুষ্টির বদলে স্থুলতা বাড়বে। ২০০৪ সালে দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর নারীদের মধ্যে ৯ শতাংশ স্থুলকার ছিল। এবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী তা বেড়ে ২৪ শতাংশে ছাড়িয়েছে। এসব জনগোষ্ঠির আর্থিক সামর্থ বেড়ে যাওয়ায় তারা পুষ্টিকর খাবার হিসেবে মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার খাচ্ছে। এতে তাদের পুষ্টি বাবদ ৪০ শতাংশ ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। সুষম খাবারের তালিকায় ভাত, রুটি, শবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও তেল জাতীয় খাদ্য রয়েছে।
বর্তমানে দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মাতৃকালীন ভাতা দেয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুষ্টিকর খাবার দেয়াসহ নানান সামাজিক কর্মসুচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দারিদ্র ও খাদ্য নিরাপত্তা হীনতায় ভোগা পরিবারকে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচির আওতায় এনে পুষ্টিকর খাবার দেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করা যেতে পারে মর্মে বিশেষজ্ঞরা মত দেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপুষ্টির কারণে কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে। রক্তস্বল্পতা, মুখের কোনায় ঘা, পেটের অসুখ, রক্ত আমাশয়, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, বিভিন্ন ধরণের চর্মরোগ, চোখের অসুস্থতা, চুল পড়া, পেটে কৃমি, দুর্বলতা, শারীরিক গঠন সুষ্ঠু না হওয়া ইত্যাদি শারীরিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে। এছাড়া, অপুষ্টির কারণে কিশোর কিশোরীর বিকাশ সঠিকভাবে হয় না। তাদের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ পরিপুর্ণভাবে ঘটে না। বুদ্ধিগত বিকাশও বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে, বড় হলে সেই কিশোর বা কিশোরী মেধাবী হতে পারে না। এ কারণে, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
দেশের মানুষের পুষ্টি ও খাদ্য নিয়ে জ্ঞান এবং সচেতনতার অভাবই এর জন্য মুলত দায়ী, অর্থনৈতিক কারণ নয়। অনেকেরই ধারনা, বেশি বেশি দুধ ও মাংস খেলে স্বাস্থ্য ভালো হয়। কিন্তু ধারণাটি ঠিক নয়। প্রতিটি মানুষেরই সুষম খাবার অর্থাৎ খাদ্যের সব কয়টি উপাদানের উপস্থিতি খাবারে থাকতে হবে, এমন সব খাবার খাওয়া উচিত। সে জন্য মাংস ও দুধের পাশাপাশি মাছ, ডিম, ডাল, ভাত, রুটি, সবজি, ফলমুল সবই খেতে হবে। এ ছাড়া বিশেষ কোনো একটি খাবার বেশি বেশি খাওয়া ভালো নয়। কিশোরী মায়েদের মাতৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে তার গর্ভধারণ হলে শিশুটির অপুষ্টি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলে অনেকে মনে করেন।
সার্বিকভাবে দেশের কিশোর কিশোরীদের অপুষ্টি দূর করতে ব্যাপক উদ্যোগ এখন থেকেই গ্রহণ করা প্রয়োজন। শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, উপযুক্ত সম্পুরক খাবার খাওয়ানো, ছয় মাস অন্তর অন্তর ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো-এই কার্যক্রম বাড়াতে হবে। শিশু বয়স থেকেই এটা করতে হবে। তাহলে শিশুরা অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিশোর বয়সে অপুষ্টির শিকার কম হবে। ভাতের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমানে ডাল, শাকশব্জি, দেশীয় ফলের চাষ বাড়াতে হবে। সমাজ থেকে অপুষ্টি দূরীকরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ সমাজের সকল স্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আয়নাদের মতো এদেশের হাজারো শিশুকে অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।