‘শতরঞ্জিতে রঙিন কুড়িগ্রামের নারীরা’

981

ঢাকা, ২৭ নভেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : কেউ ব্যস্ত শতরঞ্জি তৈরিতে, কেউবা আবার হাত পাখা। অনেকেই সেলাই করছেন কুশন। এমন দৃশ্য উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে গৃহকর্ম শেষে অবসর সময় এসব হাতের কাজ করে পরিবারের খরচে অবদান রাখছেন নারীরা। আবার অনেকেই হয়েছেন স্বাবলম্বী। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কাজেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত দিচ্ছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের যেসব নারী হস্তশিল্পের এসব কাজ করছেন তাদের বেশির ভাগই বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা কিংবা তালাকপ্রাপ্তা। হতদরিদ্র কর্মহীন নারীদের দিয়ে পাটের আঁশ দিয়ে দৃষ্টিনন্দন এসব ব্যবহার্য পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। যা দেশের বিভিন্ন বড় শহরে পাঠানোর পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে।
এতে দেশের যেমন রাজস্ব আয় বাড়ছে তেমনই স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেছেন এসব কর্মহীন নারীরাও। এসব কাজে গ্রামীণ নারীদের সহযোগিতা দিচ্ছে ‘নারী’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় কিংবা বারান্দায় সৃজনশীল হাতের ছোঁয়ায় পাটের আঁশ থেকে দৃষ্টিনন্দন শতরঞ্জি, কিচেন ম্যাট, ঝুড়ি, ব্যাগ, হাতপাখা, পাপোস, কুশন, টেবিল ম্যাট, কার্পেট, সিকা, শো-পিস, গহনাসহ ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করতে।
সোনালী আঁশ পাট আগের মতো উৎপাদন হয় না। এরপরও পাট দিয়ে কুড়িগ্রামের উলিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি হচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্য। উলিপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ৭শ’ নারীর কারুকাজ খচিত পণ্য তৈরি করছেন। তাদের তৈরি এসব পণ্য রফতানি হচ্ছে বিদেশেও।
জানা যায়, এসব কর্মহীন নারীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে ২০১৪ সালে গড়ে তোলা হয় নারী অ্যাসোসিয়েট ফর রিভাইভার ইনিসিয়েটিভ নামে একটি সংগঠন। যা সংক্ষেপে ‘নারী’ নামেই পরিচিত।
উলিপুর-চিলমারী সড়কের রামদাস ধণিরাম পাড়ায় নারীদের নিয়ে কাজ শুরু প্রথমে ‘নারী-ই’। পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগেও অনেকেই তৈরি করছেন সৌখিন এসব পণ্য।
নারী’র সংগঠক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, নারীরা দৃষ্টিনন্দন পাটজাত পণ্য উৎপাদন করছেন। যা রুচিশীল মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে অল্পদিনেই। আমাদের এ উদ্যোগ পরিবারে স্বচ্ছলতার আনার পাশাপাশি হতদরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করেছে।
এ উদ্যোগের শুরুর কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, শুরুতে সংগঠনের পক্ষ থেকে ৩শ’ তাঁত কেনা হয়। ছোট কারখানাতেই কাজ শুরু হয়। আর এ উদ্যোগে আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় নারীদের মধ্যেও। প্রথমে স্বামী পরিত্যক্তা, তালাকপ্রাপ্তারা কাজ করলেও পরবর্তীতে গৃহবধূরাও যোগ দেন।
ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, প্রথমে আশপাশের বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত, স্বামী পরিত্যক্তা ও হতদরিদ্র নারীদের সংগঠিত করে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করি। উদ্দেশ্য তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরানো।
‘এক পর্যায়ে নারীদের তৈরি পণ্য ডিসপ্লের জন্য একটি শো-রুম খোলা হয়। একই সঙ্গে প্রচারের জন্য জেলাশহরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মেলায়ও অংশ নিই। যা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে’ বলছিলেন এই সংগঠক।
তবে এ উদ্যোগের পেছনে কিছু কষ্টের কথাও জানালেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা নিজ উদ্যোগে চেষ্টা করছি। পুঁজির জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে গেলেও নারী হওয়ার কারণে ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ঋণ না পেয়ে অবশেষে শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
পাটজাত পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন শেফালী আক্তার (২০)। তার স্বামী এক সন্তান রেখে চলে যায় সেই ছেলে হওয়ার পরপরই। এখন ছেলের বয়স ৬ বছর।
‘নারী’র কারখানায় পাটজাত পণ্য তৈরি করেন তিনি। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। এ দিয়েই চলে সংসার। ছেলেকেও স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন।
তার ভাষ্য, গরিব মা-বাবার ঘরে জন্ম নেওয়ার পর অভাব অনটনে বড় হয়েছি। এর মাঝে ১৪ বছরেই বিয়ে হয়ে যায়। এর মাঝে কোলে আসে ছেলে। কিন্তু স্বামী আমাদের রেখে পালিয়ে যায়। এখনও তার খবর নেই।
‘গতবছর খোঁজ পাই ‘নারী’র। এখানে এেেস কাজ নিই। এখন নিজে চলি। কিছু টাকাও জমাই।এখন কেউ অবহেলা করে না,’ বলেন শেফালী।
তাদের মধ্যে সেলিনা বলেন, আগে খুব কষ্টে দিন কাটালেও কাজ পেয়ে সংসারে শান্তি এসেছে। স্বামী রিকশা চালায়। দুজনের আয়ের টাকায় ছেলে-মেয়েকে পড়াতে পারছি। নিজস্ব থাকার ঘর তৈরি করতে পারছি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কুড়িগ্রাম জেলার সভাপতি রওশন আরা চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে দেশে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন হয়েছে। সরকার তৃণমূল পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করছে। এরই সুফল ভোগ করছেন উলিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের নারীরা।
‘নারী’র এ উদ্যোগে বেশ উৎফুল্ল কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে। নারীরাও বিভিন্ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হয়ে পরিবারে সহযোগিতা করছে। ‘নারী’ যে উদ্যোগ নিয়েছে এতে আমাদেও সহযোগিতা থাকবে সব সময়।