পদ্মার ডানতীর রক্ষাবাঁধকে ঘিরে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে শরীয়তপুরের ভাঙ্গন প্রবণ এলাকার মানুষ

275

এস এম মজিবুর রহমান,
শরীয়তপুর, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯ (বাসস): পদ্মার ডানতীর রক্ষাবাঁধকে ঘিরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে শরীয়তপুরের ভাঙ্গন প্রবণ এলাকার মানুষ।
প্রায় এক শতাব্দী থেকে ভাঙছে শরীয়তপুরের পদ্মা তীরবর্তী এলাকা। কোন কোন বছর ভাঙ্গনের তীব্রতা কম থাকলেও নতুন করে আবার পরের বছরই পদ্মা দেখিয়েছে তার আগ্রাসী রূপ। পদ্মায় বিলীন হয়েছে একের পর গ্রাম, হাট-বাজার, সরকারী বেসরকারী স্থাপনা, রাস্তাÑঘাট, ফসলী জমিসহ হাজার হাজার মানুষের বাড়ি-ঘর। পদ্মা পাড়ের মানুষের এক সময় ছিলো গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, মাঠের পর মাঠ ফসলী জমি, বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছে ভরা সাজানো গোছানো ঘরবাড়ি। এখন আর তাদের কিছুই নেই। তারা এখন পদ্মার ভাঙ্গনে সব হারিয়ে দিশেহারা হয়ে আশ্রয় নিয়েছে খাজনায় অন্যের ফসলী জমি, বালুর মাঠ আর নদীর পাড়ে। সর্বস্ব হারিয়ে এখন অনেকে নানা প্রতিক’লতার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। তবে সব হারানো ভাঙ্গন কবলিত মানুষের মনে নতুন করে আবার ঘুরে দাড়াঁনোর সাহস যুগিয়েছে পদ্মার ডান তীর রক্ষা বাঁধ।
ভাঙ্গন কবলিত বয়োজ্যৈষ্ঠ ব্যক্তি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানাগেছে,পদ্মা প্রায় এক শতাব্দী ধরে ভাঙলে ও ২০১৬ সালের জুলাই থেকে জেলার জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নে শুরু হয় রাক্ষুসী পদ্মার সর্বগ্রাসী ভাঙ্গন। এ ভাঙ্গন চলতে থাকে ২০১৮ সালের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। যা শত বছরের ইতিহাসে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গন। ২০১৮ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ ভাঙ্গনে নড়িয়া উপজেলার মোক্তারেরচর শেহের আলী মাদবর কান্দি, কেদারপুরের সাহেবেরচর, চন্ডিপুর বাজার, সাধুর বাজার পাচগাঁও, মলফৎগঞ্জ বাজার, ৫০ শয্যাবিশিস্ট নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ উপজেলার ৫ সহ¯্রাধিক পরিবারের বিলাসবহুল পাকা, সেমি পাকা ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ কাঁচা-পাকা একাধিক সড়ক বিলীন হয়ে সর্বনাশা পদ্মায়। এর আগে ২০১৭ সালে জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নের খেজুরতলা কলমিরচর চোকদার কান্দি, মমিন খালাসি কান্দি, হাজী মকবুল খালাসি কান্দি, রিয়াজ উদ্দিন মাদবর কান্দি ও ইয়াকুব মাদবর কান্দি ও ঐ সকল এলাকার কাচাঁ-পাকা সড়ক, হাট বাজার, ফসলী জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ মক্তব আগ্রাসী পদ্মা গ্রাস করে নেয়। নড়িয়া ও জাজিরার হাজার হাজার পরিবার গৃহহীণ হওয়ার দৃশ্য নজরে আসে দেশ^বাসীর। তারই ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালে পদ্মার ডান তীর রক্ষাবাঁধ নামে এক হাজার ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একনেকে এ প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। এ বছর জানুয়ারি থেকে পুরোদমে শুরু হয় বাঁধের কাজ। ফলে এবছর পদ্মার ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেয়েছে ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ। ফলে পদ্মা পাড়ের মানুষ আবার নতুন করে নিরাপদে বসবাসের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
নড়িয়া উপজেলা সদরের মিহির চক্রবর্তী জানান, ছোটবেলা থেকেই পদ্মার ভাঙ্গা-গড়ার খেলা দেখে বড় হয়েছি। তবে গত ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পদ্মা যে আগ্রাসী রুপ দেখিয়েছে তা প্রত্যক্ষ করেছে সারা দেশের মানুষ। পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়েছে কুড়েঘর থেকে শুরু করে বহুতল পাকা স্থাপনা পর্যন্ত। তবে ২০১৮ সালে পদ্মার ডানতীর রক্ষাবাঁধের কাজ শুরু হওয়ার পর ভাঙ্গব কবলিত মানুষদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও এ বছর বর্ষায়ও আতংকে ছিল অনেকেই। কিন্তু রক্ষাবাঁধের কল্যাণে এবার পদ্মা তার আগ্রাসী রুপ ধারণ করতে না পারায় এ জনপদের মানুষ নতুন করে ঘুড়ে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছে। বিগত শত বছরেরও অধিক সময় থেকে বর্ষা আসলেই মানুষের মধ্যে ভাঙ্গনের যে আতংক কাজ করত তার অবসান হলো পদ্মার ডানতীর রক্ষাবাঁধের সুবাদে।
কেদারপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাফেজ সানাউল্লাহ বলেন, পানি সম্পদ উপ-মন্ত্রী এনামুল হক শামিমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে ২০১৮ সালে শুরু হয় পদ্মার ডানতীর রক্ষাবাঁধের কাজ। বাঁধের কাজ শরু হওয়ার পর থেকে নড়িয়ার পদ্মা পাড়ের মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হতে থাকে। আর এ বছর নদী ভাঙ্গন রোধ হওয়ার ফলে সেই আশা এখন বাস্তবে রুপ নিয়েছে। আমরা এ অঞ্চলের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ।
শরীয়তপুর পানি উপন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ কৃষ্ণ সরকার জানান, ২ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে পদ্মার ডান তীর রক্ষাবাঁধ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কাজ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ২৫ ভাগ। ২০২১ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এ রক্ষাবাঁধের ফলে এ এলাকার ১ হাজার ৮০০টি একতলা পাকা বাড়ি, ৫০০ টি দুইতলা পাকা বাড়ি, ৪ হাজার আধা পাকা বাড়ি, ৫ হাজার কাঁচা বাড়ি, রাস্তা ১২৫ কি.মি, পাকা রাস্তা ৯০ কি.মি, ব্রীজ-কালভার্ট ৫২ টি, ৫০ শয্যার একটি হাসাপাতাল, ১২ টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ২টি পুলিশ ষ্টেশন, ২৫ টি হাট-বাজার, ৫৫ টি মসজিদ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় ২৫ টি, ১১ টি মাদ্রাসাসহ প্রায় ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকার সম্পদ পদ্মার ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পাবে। যে গতিতে কাজ চলছে তাতে প্রকল্প মেয়াদের মধ্যেই আমরা কাজ শেষ করতে পারব বলে আশাবাদী
পানি সম্পদ উপ-মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, আমি এ এলাকার ছেলে হওয়ায় ছোট বেলা থেকেই পদ্মার ভাঙ্গা-গড়ার খেলা দেখে আসছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া এ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখিনি। ২০১৮ সালের পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গনের দৃশ্য দেখে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ভাঙ্গন রোধে দ্রুত কাজ করতে নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড পদ্মার ডানতীর রক্ষাবাঁধের কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করায় ও আল্লাহর রহমতের ফলে এ বছর পদ্মার ভাঙ্গন থেকে নড়িয়াসহ এ অঞ্চলের মানুষের সম্পদ রক্ষা পেয়েছে। আমরা আশাবাদী প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ ভাঙ্গন কবলিত শব্দটিই আর ব্যবহার করতে পারবে না। এছাড়াও গত ৩০ অক্টোবর তারিখে একনেকে প্রধানমন্ত্রী পদ্মার বামতীর রক্ষার জন্য ৫৫৭ কোটি ২৪ লক্ষ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছেন। এ প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন হলে ইনশাআল্লাহ শেষ হবে পদ্মার আগ্রাসী রুপের অধ্যায়।