উন্নয়নের জন্য সমবায়ী কর্মকান্ডে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্বারোপ প্রধানমন্ত্রীর

1235

ঢাকা, ২ নভেম্বর ২০১৯ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবায়ের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে যুগোপযোগী সমবায় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
তিনি বলেন, বর্তমান যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে সমবায়ের মাধ্যমেই আমাদের দেশের উন্নয়ন করতে পারবো।’
আর এজন্য দক্ষ সমবায়ীদের প্রশিক্ষণের ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সমবায়ের কাজে যারা দক্ষ তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং সৎভাবে তারা যেন কাজ করে সেই বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।’
‘ইনশাল্লাহ, তবেই জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হব,’যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৪৮ তম জাতীয় সমবায় দিবস-২০১৯ উদযাপন এবং জাতীয় সমবায় পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তাঁর সরকার ‘উন্নত জাতের গাভী পালনের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এর মাধ্যমে মহিলাদের সুদ বিহীন, জামানত বিহীন, দীর্ঘ মেয়াদী ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে।’
সমবায় ভবন নির্মাণ এবং সমবায় অধিদপ্তরের সদর কার্যালয় থেকে উপজেলা পর্যন্ত সকল কার্যালয়কে আইসিটি নেটওয়ার্কের আওতায় এনে অনলাইনে কেনা-বেচার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন এবং এই অনুষ্ঠানের শুরুতেই অনলাইনে পন্য কেনা-বেচা ও বাজারজাতকরণের বিষয়টির উদ্বোধন করেন বলেও জানান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব কামাল উদ্দিন তালুকদার, বাংলাদেশের জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের সভাপতি শেখ নাদির হোসেন লিপু অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক এবং মহাপরিচালক আমিনুল ইসলাম স্বাগত বক্তৃতা করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সিনিয়র সচিব, সচিব সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এবং সারাদেশ থেকে আগত সমবায়ীবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকান্ড নিয়ে একটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়। চলতি বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘বঙ্গবন্ধুর দর্শন, সমবায়ে উন্নয়ন।’
অনুষ্ঠানে ২০১৮ সালের জাতীয় সমবায় পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
আলোচনা পর্বের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী সমবায়ীদের জন্য অনলাইনে পন্য কেনা-বেচা ও বাজারজাতকরণের উদ্বোধন করেন এবং অনুষ্ঠানস্থলে সমবায়ীদের স্থাপিত বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।
সমবায় অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশের কৃষি, মৎস্য চাষ, পশু পালন, দুগ্ধ উৎপাদন, পরিবহন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, আবাসন, পুঁজি গঠন ও নারীর ক্ষমতায়নে সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার সমবায় সমিতি রয়েছে। যার সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৯ লাখ। এ সকল সমবায় সমিতির মোট কার্যকরি মূলধনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। সমবায়ের মাধ্যমে সৃষ্ট কর্মসংস্থানের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ।

দেশের বিদ্যমান সমবায় আইনকে যুগোপযোগীকরণ এবং সমবায় ব্যাংককে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ওপরও ভাষণে গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সমবায় আইনটিকে আরো যুগোপযোগী করতে হবে এবং সমবায় ব্যাংক যেটা রয়েছে সেটা এক সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কাজেই এই ব্যাংক আইনটাও সময়োপযোগী করে এবং এটাকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) কর্তৃক ৫টি উন্নয়ন প্রকল্পে গ্রামের দরিদ্র ও বিত্তহীন জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ, উপকরণ সরবরাহ ও ঋণ সহায়তা প্রদান করে স্বাবলম্বী করে তোলা হচ্ছে। ক্ষুদ্র কৃষকদের উন্নয়নে ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৩টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বর্তমানে ১৭৪টি উপজেলায় বিস্তৃত হয়েছে।
সেই সঙ্গে পল্লী অবকাঠামো সুবিধা ও দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)-এর মাধ্যমে সরকার ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ফলে গ্রামে আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং গ্রামের রাস্তায় সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যেখানে বিদ্যুতের গ্রিড লাইন নেই সেখানে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং দেশের শতকরা ৯৩ জন মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া নৌ পথ, সড়ক পথ এবং রেল পথ চালু করা এবং উন্নত করা এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা করার ফলে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়ছে এবং মানুষের জীবন-মান উন্নত হচ্ছে।
তাঁর সরকার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড), কুমিল্লা এর গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনার জন্য ২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
‘ভিক্ষুক জাতির কোন ইজ্জত থাকে না,’ জাতির পিতার বক্তৃতার এই উদ্বৃতির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘জাতির পিতা আমাদেরকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে সে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি। কাজেই এই দেশের মানুষ আর কোনদিন কারো কাছে হাত পেতে চলবে না, মাথা উঁচু করে চলবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াবে, সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার কৌশল ছিল সমবায়।’
‘জাতির পিতা এদেশে কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিল্প উদ্যোগ, কৃষি ঋণসহ সব ক্ষেত্রে সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কাজ করেন’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতাই সংবিধানের ১৩-নং অনুচ্ছেদে মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে সমবায়কে স্থান দিয়ে যান। তিনি (বঙ্গবন্ধু) নিরন্ন মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দিতে গঠন করেছিলেন কৃষি সমবায় সমিতি, পুষ্টির চাহিদা পূরণে গঠন করেছিলেন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি,দরিদ্র তঁাঁতীদের নিয়ে তাঁতী সমবায় সমিতি, শিল্প সম্প্রসারণে শিল্প সমবায় সমিতি এবং দেশের অন্যতম সমবায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন’।
জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে তৃণমূল পর্যন্ত উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমান নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রতিটি গ্রামে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সমবায়ের মাধ্যমে ২ লক্ষ ৯৮ হাজার ২ শত ৪৯টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ১শ ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা ঋণ সহায়তা প্রদান করে তাদেরকে স্বাবলম্বী করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি, আমার খামার’ প্রকল্পের আওতায় ৮৭ হাজার ২২৩টি গ্রামে ১ লক্ষ ৫ হাজার ৭২৩টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়েছে। যার উপকারভোগী পরিবার ৪৭ লাখের ও বেশি। একইসঙ্গে, গ্রামভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠন করে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি (সিভিডিপি) প্রকল্পের মাধ্যমে সমবায়ভুক্ত সদস্যদের লাগসই প্রশিক্ষণও প্রদান করা হচ্ছে।
দুগ্ধ খাতের উন্নয়নে সরকারের সমবায়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, ‘সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধ উৎপাদন নিশ্চিতকরণ প্রকল্প’ এবং ‘দুগ্ধ সমবায়ের কার্যক্রম বিস্তৃতকরণের মাধ্যমে বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনা জেলার দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এছাড়া, মিল্ক ভিটার মাধ্যমে গো-খাদ্য উৎপাদনের জন্য লাহিড়ী মোহনপুর দুগ্ধ কারখানায় গো-খাদ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপন করা এবং দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মহিষের কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িঘাট গুড়োঁ দুধ উৎপাদন কারখানা স্থাপন, চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুগ্ধ কারখানা স্থাপন, ‘বৃহত্তর ফরিদপুরের চরাঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও দুধের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতকরণ কারখানা স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ও তথ্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমান সরকার সমাজের অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমবায়ের মাধ্যমে গারো সম্প্রদায় এবং সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীভুক্ত জনগণের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর শতকরা ৯০ শতাংশ নিজস্ব অর্থায়নেই বর্তমানে বাস্তবায়িত হচ্ছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘আমাদের বাজেট ও আমরা ৭ গুণ বৃদ্ধি করেছি এবং ইতোমধ্যেই আমরা সল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্রাজুয়েশন লাভ করেছি।’
এই উত্তোরণকে ধরে রেখে আমাদেরকে আরো সামনে এগিয়ে যেতে হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতার নির্দেশনা অনুযায়ী এই এগিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সমবায়কে গুরুত্ব দেব। যাতে করে একসঙ্গে অধিক সংখ্যক মানুষ উপকার ভোগ করতে পারে।’