বাসস-ইউনিসেফ ফিচার-১ : তৃণমূলে সংগ্রামী এক নারী উদ্যোক্তা মর্জিনার সাফল্যের গল্প

261

বাসস-ইউনিসেফ ফিচার-১
নারী-উদ্যোক্তা-মর্জিনা
তৃণমূলে সংগ্রামী এক নারী উদ্যোক্তা মর্জিনার সাফল্যের গল্প
॥ মাহবুব আলম ॥
ঢাকা, ২৮ আগস্ট, ২০১৯ (বাসস/ইউনিসেফ ফিচার) : কিশোরী মর্জিনা বেগমের স্বপ্ন ছিল নিজে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের হাল ধরার। কিন্তু তার বাবার ছিলো অভাবের সংসার। ১৯৯৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় কিশোরী মর্জিনার বিয়ে হয়ে যায়।
স্বামীর সংসারে গিয়েও সংসারের টানাপোড়েনে পড়তে হয় তাকে। সইতে হয় নানা যন্ত্রণা। কিন্তু তিনি দমে যাননি। ছোটবেলার সেই স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন মনে আবারও চাড়া দিয়ে ওঠে।
সেই থেকেই শুরু। বড় বোন মেরিনা বেগমের সহায়তায় পোশাক তৈরির কাজ শিখেন তিনি। পাশাপাশি চালিয়ে যান পড়াশোনাও।
এরপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাকে। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি এখন গ্রামের অসহায় নারীদেরও বেঁচে থাকার গতি দেখিয়ে দিয়েছেন এক সময়ের অসহায় মর্জিনা।
এখন তার বাড়ির নিয়মিত দৃশ্য, নারীরা গোল হয়ে বসে বসে পুঁথির ব্যাগ, ওয়ালম্যাট, ফুলের টবসহ নানা জিনিসপত্র তৈরি করেন। হস্তশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা এখন স্বাবলম্বী। এ কাজে তাদের নেতৃত্ব দেন মর্জিনা।
সম্প্রতি বগুড়া জেলার শেরপুরের মির্জাপুর ইউনিয়নের মদনপুর গ্রামের মূল সড়ক থেকে এগিয়ে নারী উদ্যোক্তা মর্জিনার টিনশেডের পাকা বাড়িতে গিয়ে এমনটাই দেখা যায়।
আলাপচারিতায় জানালেন, সেলাই ও হস্তশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে মর্জিনা এখন মাসে আয় করেন ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। গ্রামের অন্য নারীদেরও স্বাবলম্বী করার পথ দেখিয়েছেন তিনি। অবসর সময়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেন মর্জিনা।
তার ভাষ্য, এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০০জন নারীকে কাজ শিখিয়েছি। তারা এখন স্বাবলম্বী। পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটান তারা। এটা আমার জন্যও বেশ আনন্দের ও সুখের।
তবে পথচলাটা সুখের ছিল না মর্জিনার। এজন্য তাকে অনেক কাঠ-খড় পোহাতে হয়েছে। অতীতে নিজের কঠোর পরিশ্রমের কথা যেমন জানালেন, তেমনি বললেন নানা অর্জনের কথাও।
মদনপুর গ্রামের কৃষক সুজির উদ্দিনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে মর্জিনা চার নম্বরে। মা জয়গুন বিবি গৃহিণী। ১৯৯৫ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয় মর্জিনার। শ্বশুরবাড়িও একই গ্রামে। স্বামী বাসচালকের সহকারী (হেলপার) ছিলেন।
মর্জিনা বলেন, বিয়ের পর বাবা আমায় দুই বিঘা জমি দিয়েছিলেন। ওই জমির আয় থেকে জায়গা কিনে বসতবাড়ি করেছি। ওই বাড়িতে স্বামীর সঙ্গে থাকতাম।
তিনি জানান, সংসার সামলানোর পাশাপাশি লুকিয়ে লেখাপড়াও চালিয়ে যান মর্জিনা। স্থানীয় মাদরাসা থেকে ২০০০ সালে দাখিল পাস করেন। পরে উপজেলা যুব উন্নয়ন কার্যালয়ের সহায়তায় দুই বছরের প্রশিক্ষণ নেন। ২০১০ সাল থেকে ইউনিয়ন তথ্যসেবা ও ডিজিটাল সেন্টারেও কাজ করছেন তিনি।
তবে স্বামীর সঙ্গে ঠিক বনিবনা হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে ২০১৩ সালে স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে। পরের বছর আলিম পরীক্ষা দেন, পাসও করেন।
ওই বছরই জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশের তালিকায় উপজেলা পর্যায়ে ২০১৪ সালে শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী নির্বাচিত হন তিনি। একই সঙ্গে তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা হিসেবেও তালিকাভুক্ত সংগ্রামী নারী মর্জিনা।
তিনি বলেন, এ পর্যায়ে আসতে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেক মানুষের কটুকথাও শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার লক্ষ্য থেকে সরে যাইনি। কাছের কিছু মানুষ আমায় নীরবে সহযোগিতা করে গেছেন। তাদের জন্যই আজ আমার এখানে আসা।
মর্জিনার এ সাফল্যে আনন্দিত স্থানীয়রা। মির্জাপুর ইউনিয়নের মদনপুর ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মমতাজ আলী বলেন, ইচ্ছা থাকলে যে উপায় হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ মর্জিনা। সে শূন্য থেকে শুরু করেছিল।
‘নিজ চেষ্টা আর পরিশ্রমে আজকের জায়গায় এসেছে। তার সাফল্যে আমরাও যারপরনাই খুশি। তার দেখাদেখি গ্রামের ও আশপাশের অনেকেই এখন স্বাবলম্বী,’ বলেন তিনি।
বাসস-ইউনিসেফ ফিচার/মাহবুব/কেজিএ/১০০০/আহো/-এসএইচ