নাটোরে অল্প দিনের মধ্যে বাজারে আসছে সজিনা

488

নাটোর, ১৭ মার্চ, ২০১৯ (বাসস) : পুষ্টি ও ওষুধি গুণাগুণের কারণে অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ হিসেবে পরিচিত সজিনার আবাদ বেড়েছে নাটোরে, বেড়েছে সজিনা গাছের সংখ্যা। বসন্তকে সুবাসিত করতে সজিনা ফুল অনন্য। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঝড়-বৃষ্টির কারণে এবার মৌসুমী সজিনার ফলন কমতে পারে। অল্প ক’দিন পরে বাজারে উঠতে শুরু করবে সজিনা।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন সজিনার পুষ্টিগুণ ব্যতিক্রমধর্মী। আমিষের অনুপাত বিবেচনায় সজিনা গাছকেই পৃথিবীর সেরা গাছ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর পাতায় ৩৮ রকম অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিড সহ ৩৮ শতাংশ আমিষ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সজিনার পাতা পুষ্টিগুণের আঁধার। পরিমাণের ভিত্তিতে তুলনা করলে একই ওজনের সজিনা পাতায় কমলা লেবুর সাতগুণ ভিটামিন সি, দুধের চারগুণ ক্যালসিয়াম এবং দুইগুণ আমিষ, গাজরের চারগুণ ভিটামিন ‘এ’, কলার তিনগুণ পটাসিয়াম, পালংশাকের তিনগুণ লৌহ বিদ্যমান। পুষ্টি ও ওষুধি গুণ বিবেচনায় এ গাছকে অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ বলা হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় এটি একটি মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ।
ভারতীয় আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্র মতে, সজিনা গাছ ৩০০ রকমের রোগ প্রতিরোধ করে এবং আধুনিক বিজ্ঞানও এ ধারণাকে সমর্থন করে। সজিনার বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ওষুধি গুণ আছে। সজিনা বাতজ্বর চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। পোকার কামড়ে এন্টিসেপটিক হিসেবে সজিনা পাতার রস ব্যবহার হয়। মাথা ব্যথায় সজিনার কচিপাতা কপালের দুই পাশে ঘষলে ব্যথা উপশম হয়। সজিনা গ্যাস্টিক রোগের বায়ুনাশক হিসেবে কাজ করে। পাতার রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়। শ্বেতীরোগ, টাইফয়েড জ্বর, প্যারালাইসিস এবং লিভারের রোগে সজিনার রস উপকার। ক্ষতস্থান সারার জন্য সজিনা পাতার পেষ্ট কার্যকরি। খাদ্যাভাসে সজিনা গাছের পাতা বা সজিনা থাকলে চোখের ছানিপড়া রোগ কম হয়। সজিনা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। শ্বাসকষ্ট, মাথাধরা এবং মাইগ্রেন চিকিৎসায় সজিনা ভাল কাজ করে। ভারত, চীনসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে সজিনা পাতার পাউডার দিয়ে তৈরি ক্যাপসুল বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ পীড়িত অনাহার ও অপুষ্টি শিকার মৃতপ্রায় রোগাক্রান্ত শিশুদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য সজিনার পাতা ও পাতার গোড়া খাওয়ানোর কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
সজিনার মূল ফলন শেষে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গাছ থেকে ডাল সংগ্রহ করে কার্টিং রোপণ করা হয়। বসতবাড়ি, রাস্তার ধারসহ যে কোন স্থানের মাটিতে ৩ মিটার দূরত্বে কার্টিং রোপণ করা যায়। ৪০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ডাল কাটলে ও একইভাবে রোপণ করলে শেঁকড় গজানো ও ঝরের প্রভাবমুক্ত থাকা সম্ভব বলে কৃষিবিদদের ধারণা। রোপনকালে গোবর সার এবং দ্রুত শিকড় গজানোর জন্য সামান্য ফরফরাস সার ও ছাই ব্যবহার করা উত্তম। আর গাছের উচ্চতা এক মিটার হলে ডগা কেটে এর আকৃতি ঝোপালো করা হলে ফলন বৃদ্ধি পায় এবং সজিনা সংগ্রহে সুবিধা হয় বলে জানান নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক স ম মেফতাহুল বারি।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৪৭০ হেক্টর আবাদি এলাকা থেকে সাত হাজার ৪৪৭ টন সজিনা উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর চেয়ে উৎপাদন এলাকা ও ফলন অনেক বেড়েছে। বিগত বছরে ৪৪৫ হেক্টর থেকে ছয় হাজার ২৩০ টন সজিনা উৎপাদন হয়। পাঁচ বছর আগে ১২৮ হেক্টরে ১ হাজার ৯২০ সজিনা উৎপাদন হয়েছিল। অর্থাৎ বিগত বছরগুলোতে সজিনার আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণে।
বসতবাড়ি ছাড়াও রাস্তার দু’ধারে সজিনার গাছ চোখে পড়ে। নাটোর সদর উপজেলার রুয়েরভাগ এলাকার কৃষক মজিবর রহমান তার বসতবাড়ি ছাড়াও বাড়ি সংলগ্ন রুয়েরভাগ-বালিয়াডাঙ্গা সড়কের দ’ুধারে প্রায় ১০০টি সজিনার কার্টিং ও চারা দু’বছর আগে রোপন করেন। এবার এসব গাছ থেকে ফলন পাওয়া যাবে।
চন্দ্রকোলা কৃষি ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আতিকুর রহমান বলেন, একটি গাছ থেকে দুই মণ সজিনা সংগ্রহ করা সম্ভব। সজিনা চাষ বৃদ্ধি পাওয়াতে বাজারে বিক্রির মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক সংগতিও বেড়েছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া কৃষি ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সেলিম রেজা জানান, মহিষভাঙ্গা গ্রাম সজিনার আবাদে শীর্ষে। এ গ্রামের সাহাবুদ্দিন পাঠানের বাড়ির আঙ্গিনা জুড়ে ৫০ সজিনার গাছ। তিনি এবার বাড়িতে খেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনদের বিতরণ করার পরও অন্তত ২০ মণ সজিনা বিক্রি করবেন বলে আশা করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দিনের ঝড় ও বৃষ্টিতে সজিনা ফুলের ক্ষতি হয়েছে। তাই এবার ফলন কম হবে বলে জানালেন সিংড়া উপজেলার বড়সাঁঐল গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম
বড়াইগ্রাম উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ বলেন, এবার উপজেলার ২৩টি ব্লকে বিদ্যমান সজিনা গ্রামের পাশাপাশি নতুন সজিনা গ্রাম তৈরি করা হবে। সজিনার আবাদ বাড়াতে নতুন কার্টিং রোপণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্লক কর্মকর্তা ছাড়াও কৃষি কলেজসমূহের ইন্টার্ণীরত শিক্ষার্থীরা কর্মসূচিতে সহযোগিতা করবে।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদুল ইসলাম জানান, গাছে গাছে সজিনা ধরেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে আগাম সজিনা বাজারে উঠতে শুরু করবে।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মোঃ রফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, নাটোরে অত্যাশ্চার্য বৃক্ষ সজিনার আবাদ ও উৎপাদন ক্রমশঃ বাড়ছে। সজিনার সকল উপাদান অর্থাৎ সজিনাসহ এর ফুল ও পাতার যথাযথ ও বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে সুফল প্রাপ্তির পরিধি আরো বাড়বে।