প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ

2070

ঢাকা, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ (বাসস) : প্রতিবন্ধীরা এ সমাজেরই অংশ। সমাজে অনেকেই তাদেরকে সমান চোখে না দেখলেও একটা ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে তারা অনেক এগিয়ে। প্রতিবন্ধীরা নিয়মানুবর্তী। কাজ থেকে প্রতিবন্ধীদের ঝরে পড়ার হার শূন্য। তবু যোগ্যতা স্বত্বেও তারা কাজ পায় না। অনেকেই মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রির সাথে সর্বপ্রকার যোগ্যতা অর্জন করলেও মানসিকতার কারণে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সমাজের বড় একটা অংশ এই প্রতিবন্ধীরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান সহজ করার লক্ষ্যে গত তিনবছর যাবত আয়োজন করা হচ্ছে চাকরি মেলার। বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান বাড়াতে গ্রহণ করছে নানমুখী প্রকল্প। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী হলেও তাদের একটি বড় অংশের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করা যাচ্ছে না চাকরিদাতাদের অনাস্থার কারণে। সরকারি অফিসে ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধীকে কাজের সুযোগ দেয়া বাধ্যতামূলক। বর্তমানে ১৪টি মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী ও অটিজম আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তবে ৮টি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে খুব বেশি তৎপর। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা কিশোর কুমার সিংহ বলেন, প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। সেক্ষেত্রে সামষ্টিক পর্যায়ে সরকারি নীতির সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনগুলোর কাজের সমন্বয়, সরকারি নীতিকে কার্যকর করা এবং প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর সমন্বয় দরকার। সেই সমন্বয় না হওয়ায় কাজের ঘাটতি থেকে যায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারি অফিসে ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধীকে কাজের সুযোগ দেয়া বাধ্যতামুলক।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কাজের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কাজ থেকে প্রতিবন্ধীদের ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্য, কেননা তারা অনেক বেশি নিয়মানুবর্তী। ব্র্যাকের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রধান কর্মকর্তা আহমেদ তানভির আনাম জানান, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৪৫৩ জন প্রতিবন্ধী তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ২০১৭ সালে এ কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছেন ৮৬৭ জন। তাদের মধ্যে ৯৯ শতাংশের চাকরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রতিবন্ধীদের দক্ষতা কাজে লাগানোর সাফল্য কী করে প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও অর্জন করা যায়, সেই পথ খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন প্রতিবন্ধী বান্ধব সুশীল সমাজ।
প্রতিবন্ধীদের চাকরি দেয়ার লক্ষ্যে দেশে প্রায়শই চাকরি মেলার আয়োজন করা হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সিলেট চেম্বার অফ কমার্স আ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির উদ্যোগে ১৮ আগস্ট একটি চাকরি মেলার আয়োজন করা হয়। সিলেটের বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদন ও বিপননকারী প্রতিষ্ঠান, আবাসিক হোটেল, রেস্তোরা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এই চাকরি মেলায় অংশ নেয়। এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য চার শতাধিক প্রতিবন্ধী আবেদনপত্র জমা দেন। অর্ধশতাধিক প্রতিবন্ধীকে চাকরি দেয়া হয়।
এর আগে গত বছরের শেষ দিকে তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবন্ধীদের চাকরি মেলা। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এর আয়োজন করে। জানা গেছে, এ মেলা থেকে স্বনামধন্য অনেক প্রতিষ্ঠানই খুঁজে নিয়েছে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে। উদ্যোক্তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী তিন বছরে সাড়ে তিন হাজার প্রতিবন্ধীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাকরি নিশ্চিত করা হবে এবং আইটি সেক্টর ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সারাদেশে ২৮টি সেন্টারে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এবং সে লক্ষ্যে কাজও চলছে।
প্রতিবন্ধীতার সঙ্গে বেকারত্ব এ দুটোতেই পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন ফরিদপুরের মোজাম্মেল হক মিয়া। মার্কেটিংয়ে অনার্স-মাস্টার্সে ভালো ফলের পরও কোনো কাজ পাননি। ভাঙা পা নিয়ে হাঁটা গেলেও বেকার জীবন টেনে নেয়া বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ হাতে পান নিয়োগ পত্র। মানে চাকরি নামের সেই সোনার হরিণ। প্রতিবন্ধীদের জন্য চাকরি মেলায় নিয়োগপত্র হাতে পান মোজাম্মেল। এখন আশুলিয়ার ইএসকেই ক্লথিং পোশাক কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা তিনি। প্রতিবন্ধীদের জন্য কর্মসংস্থান মেলায় এমন শতাধিক প্রতিবন্ধীর বেকারত্ব ঘোচে।
ন্যাশনাল অ্যাডভাইজর কমিটি অন অটিজমের চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ চাকরি মেলা উদ্বোধনের সময় বলেন, ‘সবার জন্য সমাজ গড়তে হলে প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য তাদের কাছে আমাদের জানতে হবে তাদের কোন জায়গায় অসুবিধা হচ্ছে। সে অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, আমরা যারা সুস্থ স্বাভাবিক, আমরা তাদের অসুবিধাগুলো শুধু অনুভবের চেষ্টা করি। কিন্তু প্রকৃত অসুবিধাগুলো তাদের কাছ থেকে জানতে হবে। তাহলেই তা সমাধান সম্ভব। আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি তা বদলাতে হবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সব বাধা দূর করা সম্ভব। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কী সমস্যা তা তার কাছ থেকেই শুনতে হবে এবং তাদের অসুবিধা, মানবাধিকার ও স্বপ্নপূরণের কথা শুনলেই আমাদের দেশের উন্নতির ধারা আরো বেগবান হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধীকে বাদ দিয়ে এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিবন্ধীদের নিয়োগ বিষয়ে সিআরপির প্রশিক্ষণ সমন্বয়ক রমেশ চন্দ্র হালদার বলেন, প্রতিবন্ধীদের নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে পোশাক খাতের কয়েকটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে। বিশেষ করে যেসব কারখানা থেকে এই ব্র্যান্ডগুলো পোশাক নিয়ে থাকে। গত ১১ বছরে এভাবে দুই হাজার প্রতিবন্ধী বিভিন্ন কারখানায় নিয়োগ পেয়েছেন।
প্রতিবন্ধী মো. শাহজাহান বলেন, আমরা কোটায় চাকরি চাই না, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি চাই। কারণ চাকরি আমার অধিকার।
পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের (সিআরপি) নির্বাহী পরিচালক শফিক-উল ইসলাম সরকারি নীতির সঙ্গে বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের একসঙ্গে কাজ করার ওপর জোর দেন।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/ফই/স্বব/আহো/১০০০/এসএইচ