বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : শুঁটকিপল্লীতে কাজ করে সাবলম্বী সাগর পাড়ের প্রান্তিক নারীরা

185

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
প্রন্তিক নারী-স্বাবলম্বী
শুঁটকিপল্লীতে কাজ করে সাবলম্বী সাগর পাড়ের প্রান্তিক নারীরা
॥ তাসলিমা সুলতানা ॥
ঢাকা, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ (বাসস) : নূর বানুর বয়স পঞ্চাশের কোটায়। সংসারের ঘরকন্নার পাশাপাশি আজ শুঁটকিপল্লীতে কাজ করে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। শুধু নূর বানু-ই নন, তার মতো আরো অনেক নারী কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে কাজ করে বর্তমানে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই শুঁটকি মহালে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন তারা। এভাবে সংসারে সিদ্ধান্ত নেয়ার পাশাপাশি সাবলম্বীও হয়েছেন অনেকে।
কক্সবাজার শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সাগরপাড়ে প্রায় ৫শ’ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল। এ মহালে কাজ করেন নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক। যার অধিকাংশ-ই নারী। শুঁটকি শুকানো থেকে শুরু করে প্যাকেটজাতকরণসহ অন্যান্য কাজ করেন তারা।
শ্রমিকদের একজন শহরের সমিতিপাড়ার নূর বানু। দুই মেয়ে ও এক ছেলে আর স্বামী নিয়ে তার পাঁচজনের সংসার। ছেলেটি প্রতিবন্ধী। তার স্বামী সমুদ্র সৈকতে বিভিন্ন খেলনা দ্রব্য বিক্রি করেন। আর তিনি সংসারের কাজকর্ম শেষ করে অবসরের সময় দেন শুঁটকি মহালে।
নূর বানু জানান, চার বছর আগে এখানে কাজ শুরু করেন তিনি। তখন তাকে বেতন পেতেন ১৫০ টাকা। এখন পান ২৫০ টাকা। স্বামীকে সহযোগিতা করতেই এ কাজে যোগ দিয়েছেন তিনি।
নূর বানু বলেন, ‘সেই ভোর থেকে কর্মব্যস্ততা শুরু। চলে সূর্য ডোবা পর্যন্ত। কষ্ট হলেও সাংসারিক খরচে অবদান রাখতে পেরে আমি বেশ খুশি।’
তার মতো এখানে কাজ করেন কুতুবদিয়াপাড়ার বাসিন্দা আরিফা বেগম। পাঁচ ছেলে-মেয়ে রেখে স¦ামী অন্যত্র বিয়ে করায় প্রথমে অকূল পাথারে পড়েন তিনি। পরে তিনি নূর বানুর সহায়তায় যোগ দেন শুঁটকি মহালে। তার সঙ্গে কাজ করেন তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেও। সব মিলিয়ে রোজ ১০০০-১২০০ টাকা হয়। এ দিয়েই চলে সংসার।
আরিফা বলেন, সারাদিন কাজ করে আড়াইশ টাকা বেতন পাই। এটা কম তবে। আমাদের এটাই বা দেয় কে? পুরুষের তুলনায় মজুরি কম হলেও আমাদের খেয়েপরে চলে যাচ্ছে।
আরেফা বলেন ‘আমরা আগে ঘর থেকেই বের হতে পারতাম না। কত রকমের বাঁধা ছিল। এখন আর সেসব নেই।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পুরুষেরাও সারাদিন কাজ করে, আমরাও সারাদিন কাজ করি। সমান কাজ করলেও মজুরি পাই তাদের থেকে অর্ধেক। শুধু আমরাই না। এখানে অনেক নারী শ্রমিকই রয়েছেন, যাদের স্বামীরা তাদের ফেলে চলে গেছেন। কেউ কেউ মারা গেছেন। তাই বাধ্য হয়ে সংসারের হাল ধরতে এ কাজ করছি আমরা। চলে যাচ্ছে এভাবেই।’
জানা যায়, শুধু নাজিরারটেক নয়, গত অক্টোবর থেকে সাগরপাড়ের বিভিন্ন এলাকায় শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার ওপর পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয় এখানে। বঙ্গোপসাগর থেকে ধরা ছোট-বড় প্রায় ৪০টির বেশি প্রজাতির মাছের শুঁটকি হয় এই পল্লীতে। সোনাদিয়া দ্বীপ ছাড়াও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় অনেক শুঁটকিপল্লী। এগুলো হচ্ছে- রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা পোপা, কচাদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, নাইল্যামাছসহ আরো কয়েক প্রজাতির শুঁটকি।
সোনাদিয়া দ্বীপে শুঁটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন সখিনা খাতুন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় বলে চললেন শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়া।
জানালেন, এখানে দৈনিক তাদের দেওয়া হয় সাড়ে ৩০০ টাকা। তা দিয়েই চলে যায় সংসার। আগে তার স্বামী সাগরে মাছ ধরলেও এখন সমুদ্র সৈকতে শামুকের তৈরি বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্য বিক্রি করেন।
সখিনা বলেন, আগে কোনো কাজ করতাম না। স্বামীর সংসার চালাতে কষ্ট হতো। সংসারের কোনো কাজকর্মেও আমার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। এখন উপার্জন করি। দুইজনে মিলে সংসার চালাই। কোনো অভাব নাই।
নাজিরারটেক শুঁটকি মহালের শ্রমিকদের নেতা মো. কায়সার উল্লাহ জানান, পুরুষদের তুলনায় নারী শ্রমিকরা বেশি যতœ করে কাজ করেন। কিন্তু সে অনযায়ী বেতনটা আরেকটু বেশি হলে ভালো হয়। এখানে পুরুষ শ্রমিকরা ৪০০-৫০০ টাকা পান। আর নারীরা ২৫০-৩৫০ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই মহালে শুধু কক্সবাজারের নয়, উপযুক্ত (লবণাক্ত) আবহাওয়ার কারণে প্রতিবছর চট্টগ্রামে থেকেও বিপুল পরিমাণ কাঁচামাছ শুকানোর জন্য এই মহালে আনা হয়, এবারও আনা হচ্ছে। উৎপাদনও বেশ ভালো।
নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিক উল্লাহ জানান, প্রতি মৌসুমে শুধু এখানেই মাছের গুড়িসহ প্রায় ২০ হাজার টন শুঁটকি উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
তিনি জানান, বর্ষাকাল ছাড়া বছরের ৯ মাস এখানে শুঁটকি উৎপাদন চলে। এই মহালে প্রায় এক হাজারের মতো আড়ত রয়েছে। যারা এখানে উৎপাদিত এসব শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতনি করছে।
যোগাযোগ করা হলে জেলা মৎস্য কর্মকতা ড. আব্দুল আলীম বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষ করে ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। শুধু কক্সবাজারে নয়, এখানে উৎপাদিত শুটকি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের চাহিদা মেটানো হচ্ছে।
‘এখানে উৎপাদিত শুঁটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। যেখান থেকে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/তাসুু/আরজি/আহো/০৯৩০/এসএইচ