পোশাক শিল্পে কর্মরত নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে

1399

॥ এমরানা আহমেদ ॥
ঢাকা, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৯ (বাসস) : কিশোরী নার্গিস আক্তার (প্রকৃত নাম নয়) কাজ করেন কাওরান বাজারের এক পোশাক কারখানায়। থাকেন স্থানীয় এক বস্তিতে। সন্ধ্যা কিংবা রাতে, কাজ শেষে, যখন বাসায় ফেরেন, তখন পথে নিত্যদিনই সইতে হয় নানা ধরনের আজে-বাজে মন্তব্য। কেউ কেউ আবার গায়ে হাত দেয়ারও চেষ্টা করে। আর অফিসে কিছু-কিছু পুরুষ সহকর্মীর অযাচিত হাসি-তামাশামূলক আচরণ ভীষণ অপমানজনক বলে মন্তব্য করেন নার্গিস। আর অফিসে আসতে একটু দেরি বা কাজে একটু ভুল হলে সুপারভাইজারের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের অতিষ্ঠ হয়ে নিজের কাজের প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলছেন বলে এই প্রতিবেদকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন নার্গিস আক্তার। তার মত তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত লুবনা, সুমি, হনুফা, রানীসহ প্রায় অনেকেরই অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। কারো কারো ক্ষেত্রে এ অভিজ্ঞতা আরো তিক্ত বলেও জানান তারা।
দেশে বিজিএমইএ’র নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা ৫ হাজার ৯২৫টি। বর্তমানে এ শিল্পে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন, যার ৮০ শতাংশই নারীশ্রমিক। সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা গেছে, পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের ২২ শতাংশ কারখানার ভেতরে অথবা বাইরে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। পাঁচটি বেসরকারি সংগঠন- ব্র্যাক, ক্রিশ্চিয়ান এইড, ব্ল্যাস্ট, নারীপক্ষ ও এসএনভি- এদের মিলিত উদ্যোগে ‘সজাগ’ নামে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। গত বছর মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সাভার আশুলিয়া ও গাজীপুর এলাকার ৮টি কারখানার ৩৮২ জন নারী পোশাক শ্রমিকের ওপর এক গবেষণায় পাওয়া তথ্য মতে, তৈরি পোশাক কারখানায় ১১ শতাংশ নারী কর্মীই কর্মক্ষেত্রে নিজেকে অনিরাপদ মনে করেন। এছাড়া ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ নারী মনে করেন কারখানায় যৌন হয়রানী প্রতিরোধ কমিটি নেই বা কোথাও থাকলেও তা কার্যকর নেই।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় নারী কর্মীরা জানান, তাদের কর্মজীবন ও ব্যক্তি জীবনে বিশেষ করে পারিবারিক জীবনে নানা নির্যাতন এবং নিপীড়নের শিকার হন। এসব শিকার শ্রমিকের শিশুরাও নির্যাতনের হচ্ছে। কারণ, সামাজিক যে নিরাপত্তাহীনতার বলয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বাস করে তাদের সন্তানেরাও তার বাইরে নয়।
অন্যদিকে, তৈরি পোশাক খাতের নারী শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত ‘কর্মজীবী নারী’র ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কর্মরত ১৫০ জন নারী শ্রমিকের ওপর দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এসব নারী শ্রমিকের মধ্যে ১২৬ জন কর্মক্ষেত্রে মৌখিক নির্যাতনের শিকার হন। আর যৌন নির্যাতনের শিকার হন ১৮ জন। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন যথাক্রমে ১০৬ দশমিক ৫ এবং ৩০ জন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) অধ্যাপক জাকির হোসেন ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোস্তাফিজ আহমেদ এ গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেন। মূল প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেন, বেশির ভাগ নারী পোশাক শ্রমিক কাজে যোগ দেওয়ার সময় নিয়োগ সংক্রান্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ১৫০ জনের মধ্যে ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ (৭৬ জন) বলেছেন, তাঁরা নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বই, উপস্থিতির কার্ড পান না। এর অর্ধেকই (৫০ শতাংশ) দৈনিক ৯-১০ ঘণ্টা কাজ করেন। বাকি অর্ধেক নারী শ্রমিক দৈনিক ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ বলেন, তাঁরা গড়ে দৈনিক ৩ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় কাজ করেন। অথচ তাঁরা নিজেদের ইচ্ছায় অতিরিক্ত সময়ের এ কাজ করেন না, বরং অনেক সময় তাঁদের বাধ্য করা হয়। তৈরি পোশাক কারখানায় কাজের ধরন অনুযায়ী বিশ্রাম একটি অংশ হলেও ৭০ শতাংশের বেশি নারী শ্রমিক বলেছেন, তাঁরা বিশ্রামের সময় পান না। ৭৪ শতাংশ নারী শ্রমিকের রাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। জরিপে অংশ নেয়া ২৫ শতাংশ নারী শ্রমিক জানান, তারা সব সময় সাপ্তাহিক ছুটিও পান না।
এছাড়াও নারী শ্রমিকদের ওপর করা গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, শ্রম আইন অনুযায়ী নির্ধারিত চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভবতী হওয়ার পর নারী শ্রমিকের কাজ চলে যায়।
বাংলাদেশ সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের প্রধান নাজমা আক্তার বলেন, ‘নারীরা পোশাক কারখানায় নেতৃত্বের দিক দিয়ে অনেক দুর্বল। আরেকটা বিষয় হলো, নারীকে পোশাক কারখানায় নারী হিসেবে নয়, সস্তা শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর সেই বিবেচনার কারণে প্রতিনিয়তই নারীরা নানা ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এই নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এসব নিয়ে ভাবতে হবে।’