ভোটের ব্যবধান কারচুপির দাবি মিথ্যা প্রমাণ করে : জয়

380

ঢাকা, ১২ জানুয়ারি, ২০১৯ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ে ভোটের ব্যবধানের কথা টেনে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট কারচুপির যে দাবি করছে তা পরিসংখ্যান মোতাবেক একেবারেই অসম্ভব। ভোটের এই ব্যবধান কারচুপির দাবিকে সমর্থন করে না।
জয় তার ফেসবুকে আজ এক পোস্টে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে প্রায় ৪ কোটি ৯০ লক্ষ বেশি ভোট পেয়েছে। এতো বড় ব্যবধানের জয় কখনোই কারচুপির মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব না।’
তিনি বলেন, ‘তা পরিসংখ্যান মোতাবেক একেবারেই অসম্ভব।’
জয় বলেন, ‘সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টকে বাংলাদেশের মানুষ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই তারা এখন তাদের বিদেশী প্রভুদের কাছে নালিশ করছে ও সাহায্য চাইছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগ ও লবিং এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে চাইছে যে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন ‘তারা বলছে ভয়-ভীতির কথা, কিন্তু যদি আমরা ধরেও নেই আওয়ামী লীগের বাইরের সকল ভোট বিএনপি-জামাত এর পক্ষেই যেত, তাহলেও ২ কোটি ২০ লক্ষ ভোটের ব্যবধান থাকতো বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে। ‘তারপরেও আমাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা কেউ কেউ বিএনপির এই আন্তর্জাতিক লবিং-এর সাথে সমান তালে গলা মিলিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। তাদের অভিযোগগুলোর উত্তর দেয়ার পাশাপাশি আমি নিজেও কিছু কথা বলতে চাই।’
সজীব ওয়াজেদ বলেন, তাদের প্রথম অভিযোগ, ভোটার সংখ্যা ছিল অত্যাধিক, তার মানে ভুয়া ভোট দেয়া হয়েছে। এবার ভোট দেয়ার হার ছিল ৮০ শতাংশ, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ নয়। ২০০৮ সালের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনে ভোট দেয়ার হার ছিল ৮৭ শতাংশ, যা এখন পর্যন্ত রেকর্ড। সেই নির্বাচনটিতেও আওয়ামী লীগ ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ব্যাপক ব্যবধানে জয় পেয়েছিলো। ২০০১ সালে ভোট দেয়ার হার ছিল ৭৫.৬ শতাংশ আর ১৯৯৬ সালে ছিল ৭৫ শতাংশ। ওই দুইটি নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোট দেয়ার হার সামান্য বেশি ছিল কারণ এক দশকে এটাই ছিল প্রথম অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন।
তিনি বলেন, তাদের দ্বিতীয় অপপ্রচার হচ্ছে আওয়ামী লীগ নাকি এবার ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এই কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা। আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে ৭২ শতাংশ। মহাজোটের অন্যান্য শরিকরা পেয়েছে ৫ শতাংশের কম ভোট। এই ৭২ শতাংশও আওয়ামী লীগের এর জন্য সর্বোচ্চ না। কারণ ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ৭৩.২ শতাংশ ভোট। সেইবার যেমন স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে আওয়ামী লীগ বিশাল বিজয় পেয়েছিলো, এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের ভোট বাড়ার পেছনে আছে দুইটি সুনির্দিষ্ট কারণ।
জয় বলেন, প্রথম কারণটি খুবই পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ আমলে মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে যেকোনো সময়ের থেকে বেশি। আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি, মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে, দারিদ্রের হার অর্ধেক করা হয়েছে, মোটামুটি সবাই এখন শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থসেবা ও বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে ইত্যাদি। বাংলাদেশের মানুষের জন্য যে উন্নয়ন আওয়ামী লীগ সরকার করেছে তা এখন দৃশ্যমান।’
সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়ে জয় বলেন, আমাদের সুশীল সমাজ সবসময়ই বলার চেষ্টা করে বাংলাদেশের ভোটাররা নাকি পরিবর্তন চায়। এইসব ঢালাও কথাবার্তা, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ থেকেই বুঝা যায় আসলে তারা কতটা জনসম্পৃক্ততাহীন। আপনি যদি একজন সাধারণ মানুষ হন, এমনকি ধনী ব্যবসায়ীও হন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সুফল আপনিও পাচ্ছেন।
জয় প্রশ্ন তোলেন, ‘কেউ কেন এমন একটি সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিতে চাইবে যাদের আমলে তার জীবন বা ব্যবসার উন্নতি ঘটেছে?’ তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমাদের নির্বাচনী প্রচার কিন্তু গত বছর শুরু হয়নি। আমরা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে আমাদের প্রচারণা শুরু করে দিয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, জনগণের কাছে আমাদের উন্নয়েনের বার্তা পৌঁছে দোর কোনো সুযোগই হাতছাড়া করিনি। আমরা তাদেরকে বুঝিয়েছি যা উন্নয়ন ও অগ্রগতি হচ্ছে তা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণেই হচ্ছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক যত উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে তার পেছনে আছে আমাদের দলের ভিশন, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও পরিশ্রম। যার কৃতিত্ব আমাদের দলীয় মন্ত্রী, সাংসদ, কাউন্সিলরসহ সকলের। যখন আমাদের বিরোধী পক্ষ ও সুশীল সমাজ ব্যস্ত ছিল সমস্যা ও নালিশ নিয়ে, আমরা ব্যস্ত ছিলাম জনগণকে সমস্যার সমাধান দিতে।
সুশীল সমাজের একটি বড় অপপ্রচার হচ্ছে নতুন ভোটাররা রাজনৈতিক দল নিয়ে মাথা ঘামায় না ও তাদের বেশিরভাগই নাকি পরিবর্তন চায়। তারা বুঝতে পারেনি যে এই নতুন ভোটাররা আমাদের আমলের উন্নয়নের মধ্যে বড় হয়েছে যা তাদের জীবনকে করেছে আরো সহজ ও উন্নত। তারা কেন আমাদের ভোট দিবে না?
জয় বলেন, ২০১৩ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের জন্য আমি জনমত জরিপ করাই। আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন যে এবার কিন্তু সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে কোনো জরিপ আসেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে কিন্তু তারা ঠিকই একের পর এক জরিপ প্রকাশ করছিলো দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগের অবস্থা কত খারাপ। আসলে বাংলাদেশে খুব কম ব্যক্তি বা সংগঠনই সঠিকভাবে জনমত জরিপ করতে পারে। হার্ভার্ডে থাকতে আমি জনমত জরিপের ওপর পড়াশুনা করি। জরিপ করতে আমরা যাদের ব্যবহার করি তাদের বাছাই করার আগে আমি নিজে একাধিক গবেষণা সংগঠনের সাথে বসে আলাপ করি। ভুয়া জরিপ করে নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখানোর কাজ আমরা করি না, কারণ আমাদের জন্যই সঠিক তথ্যটি পাওয়া খুবই জরুরি। আমরা জানতে চেষ্টা করি নির্বাচনী লড়াইয়ে আমাদের অবস্থান ও সক্ষমতা, তাই জরিপের ব্যাপারে আমরা খুবই সতর্ক থাকি।
সজীব ওয়াজেদ বলেন, নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে আমাদের জরিপ থেকে আমরা জানতে পারি আওয়ামী লীগ পাবে ৫৭ থেকে ৬৩ শতাংশ ভোট আর বিএনপি পাবে ১৯ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট। তাহলে আমরা ৭২ শতাংশ ভোট কিভাবে পেলাম? আমাদের জরিপের জন্য স্যাম্পল নেয়া হয় ৩০০ আসন থেকে, অর্থাৎ ১০ কোটি ৪০ লক্ষ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে থেকে। কিন্তু ভোট দেয়ার হার কখনোই ১০০ শতাংশ হয় না আর ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়েছিল ২৯৮ টি আসনে। ২৯৮টি আসনে ১০ কোটি ৩৫ লক্ষ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ৮০ শতাংশ ভোট দিয়েছেন, অর্থাৎ ৮ কোটি ২৮ লক্ষ। আওয়ামী লীগ পেয়েছে প্রায় ৬ কোটি ভোট। ১০ কোটি ৩৫ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ৬ কোটি মানে ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ, আমাদের জরিপের সাথে এই বিষয়টি মিলে যায়।
তিনি বলেন, কিন্তু বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট কেন এতো কম ভোট পেলো? এটা হয়েছে কিছু যৌক্তিক কারণে। বিএনপির চেয়ারপার্সন দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত হয়ে জেলে আছেন। তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনও দন্ডিত আসামি, আছেন দেশের বাইরে পালিয়ে। তাদের সংগঠনের অবস্থা করুন। তার থেকেও বড় আরেকটি কারণ আছে যা আমাদের সুশীল সমাজ সহজে বলতে চায় না। যেই কারণটি বিএনপির জনপ্রিয়তায় ধসের পেছনে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর বলে আমি মনে করি।
জয় বলেন, জনমত জরিপগুলো থেকে আমি খেয়াল করেছি যে বিএনপি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যে অগ্নিসন্ত্রাস চালায় তার পর থেকেই তাদের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নামে। পেট্রল বোমা সন্ত্রাসের আগে জরিপগুলোতে বিএনপি আওয়ামী লীগ থেকে জনপ্রিয়তায় ১০ শতাংশ পিছিয়ে থাকতো। কিন্তু রাজনীতির নামের সন্ত্রাসবাদের কারণে তাদের সাথে আওয়ামী লীগের ব্যাবধান ৩০ শংতাংশ হয়ে যায় আর তারপর থেকেই বাড়তেই থাকে।
তিনি বলেন, এছাড়া তাদের আত্মঘাতী নির্বাচনী প্রচারণার বিষয়টিও আমাদের আমলে নিতে হবে। নির্বাচনী প্রচারণায় কমতি ছিল পরিষ্কারভাবেই। তার ওপর তারা তারেক রহমানের মাধ্যমে নিজেদের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেয়। আর মানুষের মনে ভেসে উঠে হাওয়া ভবন আমলের দুর্নীতি ও সহিংসতার দুঃসহ সব স্মৃতি। তারেক রহমান আবার মনোনয়ন দেন একাধিক চিহ্নিত অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এর মাধ্যমে কি তাদের জনপ্রিয়তা বাড়বে না কমবে?’
জয় বলেন, ‘নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সমর্থকদের তারা ইঙ্গিত দেয় যে তারা নির্বাচন থেকে সরে আসবে। আপনি যদি মনে করেন আপনার দল নির্বাচনেই আসবে না, তাহলে কি আপনি ভোট দেয়ার জন্য প্রস্তুত হবেন? এই কারণে তাদের নিজেদের সমর্থকদেরও ভোট দেয়ার হার কম ছিল যার ফলেত তারা ভোট পায়ও কম।
জয় বলেন, বিএনপি-ঐক্য ফ্রন্টের বার্তাই ছিল আওয়ামী লীগ খারাপ। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সেই বার্তা গ্রহণ করেনি কারণ তারা নিজেরাই দেখেছে কিভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেন নিজে নির্বাচনই করেননি। কারণ উনি জানতেন উনি কোনো আসন থেকেই জিততে পারবেন না। কিন্তু তারা আমাদের কিছুটা অবাকও করেছেন। ভোটের লড়াইয়ে প্রথমবারের মতন কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম একটি নয় দুইটি আসন থেকে জয়লাভ করে। কারচুপি যদি হতোই তাহলে যে দল আগে কোনো নির্বাচনেই কোনো আসন পায়নি তারা কিভাবে দুইটি আসনে জিতে?’
জয় বলেন, সত্য আসলে বেশি জটিল না। বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে তরুণরা, দেখছে কিভাবে শেখ হাসিনার মতন একজন ডাইনামিক নেত্রী দেশকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই বিরোধীপক্ষের শত অপবাদ, অপপ্রচার ও কাদা ছোড়াছুড়ি কোনো কাজে আসেনি। কারণ দিন শেষে মানুষ তাকেই বেছে নেয় যে তাকে উন্নত জীবন দিতে পারবে।