বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সাবলম্বী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা

352

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
স্কুল ব্যাংকিং-সাবলম্বী
স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সাবলম্বী হচ্ছে শিক্ষার্থীরা
॥ মো. হাবিবুর রহমান ॥
ঢাকা, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : তুষার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই নিয়মিত সঞ্চয় করতে শুরু করে। তার বাবা রেলওয়েতে চাকরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে প্রতিমাসে আবাসিক হলে থাকা, খাওয়া এবং অন্যান্য খরচ বাবদ যে টাকা পাওয়া যেত সেখান থেকে কিছু করে টাকা সে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখত।
তারপর একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ঢাকাতে এসে কর্মস্থলে যোগদান করে তুষার। ছাত্র জীবনে গচ্ছিত টাকার সাথে আরো কিছু টাকা যোগ করে অনেকদিন আগেই সে ঢাকার আদাবরে একটি ফ্লাট বুকিং দিয়েছিল। বর্তমানে সেই ফ্লাটের সে পুরোপুরি মালিক।
এ যেন ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল’ কবিতার লাইনের কথাগুলোই বাস্তবে পরিনত হয়েছে তুষারের জীবনে। আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় দিয়েও একটা বড় সঞ্চয় বা মূলধন গড়ে তোলা সম্ভব। আর এই মূলধন দিয়েই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে যে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার একটি উজ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তুষার।
মানুষ আয় করে ভোগ করার জন্য। ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানে অর্জিত আয়ের পুরোটাই মানুষ ভোগ করে না। আয়ের কিছু অংশ রেখে দেয় কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বা ব্যাংকে। এই রেখে দেয়া অংশের নাম সঞ্চয়। ব্যক্তির সঞ্চয় নির্ভর করে দূরদৃষ্টি, পারিবারিক দায়িত্ববোধ, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদির উপর। স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের সঞ্চয়ে আগ্রহী করে তোলার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে তাদের তথা পরিবার ও দেশের অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনয়ন করাই স্কুল ব্যাংকিং-এর মূল লক্ষ্য।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, স্কুল ব্যাংকিং-এ ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যাতে তারা অহেতুক টাকা-পয়সা নষ্ট না করে, সঞ্চয়ে আগ্রহী হয়। তাদেরকে গল্পের ছলে, কবিতার ছন্দে বুঝাতে হবে, তাদের ভেতরে চেতনা জাগ্রত করতে হবে। স্কুল জীবন থেকেই তারাও যেন তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে বড় সঞ্চয় তৈরি করে ভবিষ্যতের নানা দুর্যোগের হাত থেকে নিজেকে এবং তাদের পরিবারকে রক্ষা করতে পারে।
তারা বলেন, এছাড়া, শিক্ষাথীদের আরো বুঝাতে হবে যে, তাদের এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় ব্যাংকে জমা হলে, সেগুলো একত্রে বড় সঞ্চয় বা মূলধন সৃষ্টি হবে। সেই মূলধন নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানাতে বিনিয়োগ করলে তাতে কর্মসংস্থান হবে। সঞ্চিত অর্থ যখন উৎপাদন বাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয় তখন তাকে বিনিয়োগ বলে। আবার আয় হতেও সঞ্চয় ও বিনিয়োগ হবে। এভাবে চাকা ঘুরতে থাকবে। একেই বলে অর্থনৈতিক চাকা।
বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে এবং অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সম্পদ তথা সঞ্চয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কথায় আছে ‘দারিদ্র্য হলো অপরাধ ও বিপ্লবের জননী।’ তাই, ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিতে হবে যে, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য সঞ্চয় অতি আবশ্যক। অর্থাৎ সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য দরকার সুন্দর ব্যাংকিং সঞ্চয়।
শিক্ষার্থীদের হিসাব খোলার জন্য প্রাথমিক করণীয়: প্রথমিকভাবে ন্যূনতম ১০০ (একশত) টাকা জমা দিয়ে হিসাব খোলা যায়। তবে, যে কোন পরিমাণ অর্থ এই হিসাবে জমা দেয়া যাবে। এজন্য কমপক্ষে তিন কপি সত্যায়িত ছবির প্রয়োজন। যেগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বা ব্যাংক কর্মকর্তা বা শাখার যে কোন হিসাবধারীর কাছ থেকে সত্যায়িত করে নিতে হবে। ছাত্র-ছাত্রী সম্পর্কে স্কুল কর্তৃপক্ষের সনদ এবং অভিভাবকের জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা কমিশনার বা চেয়ারম্যান কর্তৃক ইস্যুকৃত নাগরিকত্ব সনদ গ্রহণ সাপেক্ষে হিসাব খোলা যাবে। হিসাব খোলার সময় অবশ্যই নমিনী (নমিনীর ছবি হিসাব পরিচালনাকারী কর্তৃক সত্যায়িত হতে হবে এবং নমিনীর মৃত্যু অথবা প্রয়োজন অনুসারে নমিনী পরিবর্তনযোগ্য) নির্বাচন করতে হবে।
সরকার সব শ্রেণি পেশার মানুষকে আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে স্কুল শিক্ষার্থীদের স্কুল ব্যাংকিং সুবিধা অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক হিসাব থাকায় ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে উঠছে। স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমের জনপ্রিয়তা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। ফলে, বাড়ছে স্কুল ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ও সঞ্চয় বা জমার পরিমাণ। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে স্কুল শিক্ষার্থীদের হিসাব সাড়ে ১৪ লাখ ছাড়িয়েছে। একই সময়ে সঞ্চয় ও জমার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, স্কুল শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং সুবিধা ও তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবার সঙ্গে পরিচিত করানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের ২ নভেম্বর স্কুল ব্যাংকিং বিষয়ে একটি পরিপত্র জারি করে। এরপর থেকেই স্কুল পড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় মুনাফার নানা স্কিমচালু করে। ২০১০ সালে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রম শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সালে। প্রথম বছরে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলা হয় ২৯ হাজার ৮০টি।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭টি হিসাব খোলা হয়। ওই সময় মোট জমার পরিমাণ ছিল ৯৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ লাখ ৫৩ হাজার ৯৩৬টি হিসাবের বিপরীতে জমাকৃত সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা।
সুনাগরিক একটি দেশে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ। সুনাগরিকের সংখ্যা যে দেশে যত বেশি সে দেশ তত বেশি উন্নত। আর সেই ব্যক্তিই সুনাগরিক যিনি বুদ্ধি, বিবেক আর আত্মসংযমের অধিকারী। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কার্যাদি সুন্দরভাবে, সুচারুভাবে সম্পাদন করার জন্য বুদ্ধি দরকার। বিবেক হল সুনাগরিকের জাগ্রত শক্তি। আর আত্মসংযম, হল সুনাগরিকের শ্রেষ্ঠ গুণ। সুন্দর হৃদয় যার তাকে সুহৃদ বলে। সুন্দর হৃদয়ের সান্নিধ্যে মানবজীবন আনন্দমুখর ও সার্থক হয়ে ওঠে।
সন্তানদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে রয়েছে সবারই অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ব্যাপারে কখনোই নির্লিপ্ত থাকা উচিত নয়। ছাত্র জীবন থেকেই তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কেননা, আজকের ছাত্র আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। অর্থনীতির মতে অধিক সঞ্চয় থেকে অধিক বিনিয়োগ এবং অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। যা একটি সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
বাসস/মোহার/আরজি/এসএইচ/২০১০/আহো/এসএইচ