এইডস প্রতিরোধের সময় এখনই

904

॥ মুসলিমা খাতুন ॥
ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : এইডস শুধু একটি রোগ নয়, বিশ্বব্যাপী সামাজিক ও উন্নয়ন সমস্যা হিসেবেও এটি চিহ্নিত হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই কম বা বেশি মাত্রায় এইচআইভি/এইডস বিস্তার লাভ করছে। এইচআইভি হলো হিউম্যান ইমিউনো-ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (ঐওঠ: ঐঁসধহ ওসসঁহড়-ফবভরপরবহপু ঠরৎঁং)। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। এক সময় পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় মানবদেহ, ঐ অবস্থাকেই ‘এইডস’ বলে। এ সময় নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়। এখন পর্যন্ত এইডসের কোনো প্রতিষেধক, টিকা বা পরিপূর্ণ কার্যকর চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। শুধু কিছু ঔষধ রয়েছে যা এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর জীবন দীর্ঘায়িত করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এইচআইভি সংক্রমিত হয়েছে যৌন প্রক্রিয়ায়। এ ছাড়া ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যেও এইচআইভি সংক্রমিত হচ্ছে। তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
পহেলা ডিসেম্বর প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘বিশ্ব এইড্স দিবস’। প্রথম দিকে আফ্রিকা, আমেরিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালন শুরু করলেও বর্তমানে দিবসটির ব্যাপ্তি ঘটেছে বিশ্বজুড়ে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পালিত হয় দিবসটি। এইড্স আজ বিশ্বব্যাপী মানব সভ্যতার অস্তিত্বের ওপর একটি বড় হুমকি স্বরূপ। এইড্স ইতোমধ্যেই বিশ্বে ১৫-৪৯ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আক্রান্তের অর্ধেকই হচ্ছে ১৫-২৪ বছর বয়সী যুবক-যুবতী।
আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের সীমান্ত পেরিয়ে ঘাতক ব্যাধি এইডস এখন এশিয়ার ভূ-খন্ডে ঢুকে পড়েছে। আফ্রিকার পর সব থেকে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এশিয়া। বিশেষ করে ভারত, চীন এবং ইন্দোনেশিয়া মারাত্মক এইড্স সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সচেতনতার অভাবে সভ্য মানুষেরা ছড়াচ্ছে এ প্রাণঘাতি রোগ একজন থেকে অন্যজনে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটা যেন ঘরে আগুন লাগার মত অবস্থা। অগ্নিকান্ডের শুরুতেই অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা জোরদার করে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এইডসের ক্ষেত্রেও তেমনি দেরি করা মানে ব্যাপক ক্ষতি, সর্বনাশ ও ধ্বংসের পথ বেছে নেওয়া। ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার তথা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের অনেকেই অজ্ঞতাবশত: বেপরোয়া ও যথেচ্ছ যৌনাচারে লিপ্ত হওয়ায় এ রোগের শিকার হচ্ছে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি সনাক্ত হয়। এরপর থেকে এইড্স-এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ ২০১৫ সালে পুরান ঢাকায় একটি জরিপ করে। এতে দেখা যায় যে, ৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিরায় মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তি এইচআইভিতে আক্রান্ত। একই এলাকায় ২০১৬ সালে আরেকটি জরিপ করা হয়। তখন দেখা যায়, শিরায় মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ এইচআইভিতে আক্রান্ত। এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, এদের ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ রাস্তায় থাকে, ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ বিবাহিত, এক বছরে একজন গড়ে ৩ দশমিক ৭ জনের সংগে যৌন সম্পর্ক করেছেন। এমনকি ৬২ দশমিক ২ শতাংশ জরিপের তথ্য সংগ্রহের (২০১৬ সালের) আগের সপ্তাহে অন্যের কাছ থেকে সিরিঞ্জ ও সুই ধার নিয়েছিলেন। প্রতিবেদনে নারীদের এইচআইভিতে সংক্রামণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ২০০৪-২০০৫ সালে শিরায় মাদক গ্রহণকারী নারীদের মধ্যে এইচআইভির কোনো সংক্রামণ পাওয়া যায়নি। ২০১১ সালে ১ দশমিক ২ শতাংশ নারীর মধ্যে সংক্রামণ ধরা পড়ে। কিন্তু ২০১৬ সালের জরিপে ৫ শতাংশের মধ্যে সংক্রামণ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের যুব সমাজ বিভিন্ন কারণে এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে এ বিশাল যুব সমাজের মধ্যে নিম্নশিক্ষার হার, এ বিষয়ে তথ্য প্রাপ্তির ঘাটতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক স্থানান্তরের উচ্চহার, বেকারত্বের উচ্চহার, বয়:সন্ধিকালে জীবন দক্ষতা ও যৌন শিক্ষার অভাব, প্রায় ৫০ লাখ যুবক বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যে নির্ভরশীলতা, অনিরাপদ যৌন মিলন, এবং যৌন বিষয়ক খোলামেলা আলোচনায় সামাজিক ও ধর্মীয় বাঁধা।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (ঝউএ) অন্যতম হচ্ছে এইড্স প্রতিরোধ। জাতিসংঘভুক্ত সবক’টি দেশেই এইড্স বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এর ভয়াবহতা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হয়। এ থেকেই বোঝা যায়, বিষয়টির গুরুত্ব কতটুকু। বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এইড্স বিষয়ে তাৎপর্য তুলে ধরে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এইড্স এর সম্পূর্ণ চিকিৎসা এখনও আবিস্কৃত হয়নি। এর কোন প্রতিষেধক ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের আচরণগত পরিবর্তনই-এর অন্যতম প্রতিরোধক। এ বিষয়টিকে সামনে রেখেই প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।
এইচআইভি সংক্রমণের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ পেতে সমাজের জন্য নিরাপদ ও উপযুক্ত সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা, যুবসমাজকে জ্ঞান ও দিক-নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন এমন বয়োজ্যেষ্ঠ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো, যুবসমাজকে তাদের আগ্রহ এবং দক্ষতা প্রকাশ করার সুযোগ সৃষ্টি করা, যুবসমাজের উন্নয়নে সহশিক্ষা (পিয়ার-এডুকেশন), কাউন্সেলিং সেবা প্রদানসহ এ সম্পর্কে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা প্রদান, সমাজের ও কমিউনিটির উন্নয়নে যুবসমাজকে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া, যুবসমাজ যে অন্যের এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল তা প্রকাশের সুযোগ করে দেয়া এবং স্বাস্থ্যসম্মত ও ইতিবাচক জীবনযাপনে উৎসাহ ও দক্ষতা প্রদানে কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য পিতা-মাতা, শিক্ষক ও বিভিন্ন স্তরের সামাজিক নেতৃবৃন্দের অধিকহারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই যুবসমাজসহ আমরা এইচআইভি/এইড্সের বিস্তার রোধ করতে সক্ষম হবো এবং এর ভয়াবহতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারব। এজন্য প্রয়োজন সবার আন্তরিক সহযোগিতা ও কার্যকর অংশগ্রহণ।