বাজিস-৩ : মেহেরপুর ও যশোর মুক্ত দিবস আগামীকাল

174

বাজিস-৩
মুক্ত দিবস
মেহেরপুর ও যশোর মুক্ত দিবস আগামীকাল
মেহেরপুর, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : আগামীকাল ৬ ডিসেম্বর মেহরপুর ও যশোর মুক্ত দিবস। এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
মেহেরপুর : ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর ওপরে ম্যারাথন আক্রমন চালাতে শুরু করে। পাকহানাদার বাহিনী অবস্থা বেগতিক দেখে যুদ্ধ সরঞ্জাম গুটাতে থাকে। ওই দিনেই মুক্তিবাহিনী সকাল থেকে মেহেরপুরের পাকবাহিনীর আস্তানা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি বর্ষণ চলে। এতে আহতও হয় বেশ কয়েকজন। ২৮ এবং ২৯ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর একের পর এক হামলায় হানাদার বাহিনী মেহেরপুরে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে পাকবাহিনী ৩০ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে গোপনে পিছু হটতে থাকাকালে হানাদার বাহিনী আমঝুপি ব্রিজ, দিনদত্ত ব্রিজের কিছু অংশ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে যায়। একই রাতে পালানোর সময় মুক্তিবাহিনীর মর্টার হামলায় কুলপালা নামক স্থানে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার রশির আহমেদ জানান, ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর সকাল থেকেই মেহেরপুর হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। ২ ডিসেম্বর জেলার গাংনী উপজেলা হানাদার মুক্ত হলে ভারতের শিকারপুরে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশন ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন তৌফিক ই এলাহী চৌধুরী চুয়াডাঙ্গা জেলার হাটবোয়ালিয়া গ্রামে এসে মুক্তিবাহিনীর ঘাটি স্থাপন করে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে ৫ ডিসেম্বর মেহেরপুরে প্রবেশ করে। পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা অসংখ্য মাইন অপসারণের মধ্য দিয়ে মেহেরপুর পুরোপুরিভাবে হানাদার মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। ভারতে আশ্রিত মানুষ এদিন থেকে মেহেরপুরে ফিরতে থাকে। মেহেরপুরের দৃষ্টিকাড়া স্থানগুলোতে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার পতাকা। বিজয়ের আনন্দে মুক্তিসেনারা গুলি ছুড়ে উল্লাস করে। সামিল হয় সাধারণ নারী পুরুষ। জয়বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয় মানুষ।
দিবসটি উপলক্ষে ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি জেলা প্রশাসক মোঃ আতাউল গণি জানান সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে বিজয় র‌্যালি শেষে আলোচনাসভার আয়োজন করেছে।
যশোর : ১৯৭১ সালের এদিনে যশোর জেলা পাকহানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর প্রচন্ড প্রতিরোধে এদিন যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (নেজারত) প্রীতম সাহা জানান, দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহরের টাউন হল ময়দান থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের হবে। র‌্যালিটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করবে। র‌্যালি শেষে মনিহারের সামনে (পুরাতন বাস টার্মিনালের পাশে) বিজয় স্তম্ভে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে পুস্পস্তবক অর্পণ করবেন সর্বস্তরের মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশ লেবারেশন ফোর্স মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বৃহত্তর যশোর জেলার (যশোর,নড়াইল,ঝিনাইদহ,মাগুরা) উপ-অধিনায়ক রবিউল আলম জানান, ১৯৭১ সালের ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এ সময় মিত্র বাহিনী সীমান্ত এলাকা থেকে যশোর সেনানিবাসসহ পাক আর্মিদের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালাতে থাকে। এক পর্যায়ে পর্যদস্ত পাকবাহিনী ৫ ডিসেম্বর থেকে পলায়ন শুরু করে। যশোর সেনানিবাস থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে খুলনার গিলাতলা সেনানিবাসের দিকে পালাতে থাকে। পাক বাহিনী ৫ ও ৬ ডিসেম্বর পলায়নকালে রাজারহাটসহ বিভিন্নস্থানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রচন্ড লড়াই হয়। ৬ ডিসেম্বর বিকেলের আগে যশোর সেনানিবাস খালি করে পালিয়ে যায় পাকহানাদার বাহিনী। ৬ ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাসে প্রবেশ করে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত মুক্তিযোদ্ধা-জনতার ঢল নামে শহরে। পাড়া মহল্লায় বের হয় খন্ড খন্ড মুক্তির আনন্দ মিছিল।
এর আগে ১৯৭১ সালের ৩মার্চ যশোর শহরে মুক্তিকামী জনতার জঙ্গী মিছিলে পাক বাহিনী গুলি চালালে শহীদ হন চারুবালা কর। এর পর যশোরে সংগঠিত হতে থাকে পাক হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের আন্দোলনকারীরা। এর নেতৃত্ব দেয় সংগ্রাম পরিষদ। সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতে থাকে ছাত্র, যুবক ও মহিলাদের। ২৬ মার্চ পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনী তদানীন্তন জাতীয় সংসদ সদস্য মশিয়ুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে ধরে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২৯ মার্চ পাকবাহিনী যশোর শহর ছেড়ে সেনানিবাসে চলে যায়। ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ অনেকেই এখানে শহীদ হন। ৩০ ও ৩১ মার্চ মুক্তিকামী জনতা মিছিল সহকারে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলা চালায়। মুক্তি পায় সকল রাজবন্দী। জুলাই মাস থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহর ও অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোতে প্রচন্ড আক্রমণ চালাতে থাকে।
যশোর ৮নং সেক্টরের প্রথম দিকের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী। পরবর্তীতে কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর মঞ্জুর। যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ৫ সেপ্টেম্বর শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ।যশোর সেনানিবাস থেকে শত্রুবাহিনী বিভিন্ন জেলা নিয়ন্ত্রণ করতো। ২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলে অভিযান শুরু করে। পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি চৌগাছা ঘিরে ফেলে সম্মিলিত বাহিনী। জগন্নাথপুর ও সিংহঝুলির যুদ্ধের পর ২২ নভেম্বর রাতে চৌগাছা শত্রুমুক্ত হয়। এ দু’টি যুদ্ধে পাকবাহিনী হেরে গেলে তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। এ সময় যশোর সেনানিবাসের তিনদিকেই মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। ৫ ডিসেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্টের অদূরে মনোহরপুর গ্রামে পাক সেনাবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াইয়ের পর এক পর্যায়ে পাক বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পিছুহটে যশোর ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেয়। যশোরে প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান চলে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর।যুদ্ধে টিকতে না পেরে ৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী যশোর ছেড়ে পালিয়ে যায় খুলনার দিকে। শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা।মুক্তিযোদ্ধারা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা বয়ে আনেন যশোরবাসীর জন্য এক বিরল সন্মান। যুদ্ধবিধ্বস্ত মুক্ত যশোর কালেক্টরেটসহ শহরে ওড়ে স্বাধীন দেশের গৌরবময় পতাকা।
বাসস/সংবাদদাতা/১২০৫/মহ/নূসী