দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের স্কুল সংখ্যা বাড়ানো দরকার

1112

ঢাকা, ২৬ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : বার বছর বয়সী রাইয়ান দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। খুব আবেগ নিয়ে দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে বই। চোখে কোন আলো নেই। আর দশটি বাচ্চার মত সাধারণ নয় সে। প্রতিটি দিন তার শুরু হয় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আর নতুন নতুন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে।
পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশে প্রায় পঞ্চাশ হাজার শিশু রয়েছে যাদের চোখে কোন ধরনের আলো নেই। আবার তাদের অধিকাংশই খুবই গরীব ঘরের সন্তান। আর এ ধরনের বাচ্চাদের জন্য খুব অল্প সংখ্যক বিশেষ স্কুল রয়েছে যেখান হতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। আর অধিকাংশ পরিবারের কাছে সরকার পরিচালিত এসব বিশেষ স্কুলই একমাত্র জায়গা যেখান হতে তাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাচ্চারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
কিন্তু এসব বিশেষ স্কুলের অধিকাংশই অপর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় বই এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে প্রাইমারী স্তরের পরে আর শিক্ষা প্রদান করতে পারে না।
এসব দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের জন্য বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের জন্য ব্যাপ্টিষ্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুল বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্ত সমাজ সেবা অধিদপ্তর এবং ক্রিস্টোফেল ব্লাইন্ডেন মিশন (সিবিএম)-জার্মানীর সহযোগীতায় কাজ করে যাচ্ছে যাতে করে তারা শিক্ষা ব্যবস্থার সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায়।
১৯৭৭ সালে মিরপুরে পাঁচ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু হয় ব্যাপটিষ্ট সংঘ স্কুলের। পরে ১৯৮৩ সালের ২৩ জানুয়ারী ১০০-আসনের ছাত্রী হোস্টেল সহ স্কুলটি তার নিজস্ব জায়গায় যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে স্কুলটিতে ২৭০ জন পড়ালেখা করছে যার মধ্যে ৩৫ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশু।
স্কুলের অধ্যক্ষ মমতাজ বৈরাগী বলেন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুদের উন্নত শিক্ষা প্রদান করা এবং তারা যেন তাদের আশপাশের সকল পরিস্থিতি বুঝতে পারে। যাতে করে তারা তাদের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারে এবং নিজের পরিবার ও সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।
তিনি বলেন, সঠিক যতœ এবং উৎসাহ পেলেই এ ধরনের শিশুরা ভালভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং পরিবার ও সমাজে ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাপ্টিষ্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং স্বাভাবিক বাচ্চাদের শিক্ষা প্রদান করছে। স্বাভাবিক বাচ্চারা এই স্কুলে প্রথম শেণী হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পায়। আর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাচ্চারা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ রয়েছে।’
মমতাজ বৈরাগী বলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েরা সবাই এই স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবে।
স্কুলের উপাধক্ষ্য রুথ মিত্র বলেন, ‘দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য এটিই একমাত্র আবাসিক স্কুল। এই স্কুলের আবাসিক হোস্টেলে ১০০-জন ছাত্রীর জন্য আসন রয়েছে। যারা মূলত অত্যন্ত দরিদ্র এবং অনগ্রসর পরিবারের সন্তান… তাদের এই হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। হোস্টেলে অবস্থান করা ছাত্রীদের জন্য ফ্রি থাকা, খাওয়া, কাপড়, চিকিৎসা এবং তাদের সকল নিত্য প্রয়োজনের ব্যবস্থা স্কুল কর্তৃপক্ষ করে থাকে।’
তিনি জানান, ২০০৭ সালের জানুয়ারী হতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং স্বাভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন বাচ্চাদের জন্য যৌথ পড়াশোনার ব্যবস্থা চালূ করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এসময় স্কুলের নাম বদলিয়ে রাখা হয় ব্যাপ্টিষ্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুল (বিএমআইএস)। আর স্কুল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ সংঘের স্যোশাল হেলথ এডুকেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (শেড) বোর্ড।
বিএমআইএস’র রয়েছে নিজস্ব ব্রেইলিং প্রেস যেখান হতে প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারী লেভেলের সকল ব্রেইলিং পদ্ধতির বই ছাপানো হয়। এখান হতে বই সংগ্রহ করে বাইরের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাচ্চারাও। এসব বই মূলত বিনা খরচে দেশের সকল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাচ্চারা সংগ্রহ করে।
বাংলাদেশ ভিজুয়্যালি ইমপায়ার্ড পিপলস সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন ভূইঁয়া বলেন বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য মাত্র সাতটি বিশেষ প্রাইমারী স্কুল রয়েছে।
তিনি বলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা উপকরণ অত্যন্ত ব্যয় বহুল। যার ফলে অনেক বাচ্চাই শিক্ষা হতে বঞ্চিত হয়। এছাড়াও অভিভাবকদের রয়েছে সচেতনতার অভাব।
ব্লাইন্ড এডুকেশন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইযেশন, সাইটসেভার্স ইন্টারন্যাশনাল, বিভিআইপিএস, চাইল্ড সাইট ফাউন্ডেশসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের সর্বোত্তম শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
সুতরাং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে দেশে স্কুল সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) ও সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের এগিয়ে এসে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের পাশে দাঁড়াত হবে। তাদেরকে যথাযথ শিক্ষার সুযোগ দিয়ে সমাজের মূল ¯্রােতে সামিল করতে হবে। তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে সমাজেরই অংশ হিসেবে। উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে তারাও সমাজে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা আজকাল প্রতিবন্ধীরা ব্যবসা, চাকুরির পাশাপাশি বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেরর অংশ। শেষ কথা হলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে।