নাটোরের সফল নারী উদ্যোক্তা হোসনে আরার পোল্ট্রি হ্যাচারি

1216

নাটোর, ২৫ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : ইনকিউবিটরের পাল্লা খুললেই লক্ষ প্রাণের স্পন্দন। কিচির-মিচির শব্দে মুখর চারিদিক। ডিমের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসছে মুরগির বাচ্চারা। আর এভাবেই জেলার সফল নারী উদ্যোক্তা হোসনে আরার পোল্ট্রি হ্যাচারিতে জন্ম নেয়া লক্ষ লক্ষ মুরগির বাচ্চা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।
দশ বছরের এই কর্মযজ্ঞে হোসনে আরা তৈরী করতে পেরেছেন অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা। এখন তার অনেক দূরে যাওয়ার প্রত্যয়।
নাটোর সদরের রাণী ভবানীর রাজবাড়ীর চারপাশের বেষ্টনী লেকের উত্তরে চৌকিরপাড় এলাকায় হোসনে আরা গড়ে তুলেছেন জিশান পোল্ট্রি হ্যাচারি, যা নাটোর জেলার পাঁচটি পোল্ট্রি হ্যাচারির মধ্যে সবচেয়ে বড়।
হ্যাচারির ইনকিউবেটরের স্যাটার অংশের মোট নয়টি কম্পার্টমেন্টে ট্রেতে করে সাজানো হয় লক্ষাধিক ডিম। ৩৭ দশমিক ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় এখানে ডিমের অবস্থান ১৮ দিন। এরপর ডিমগুলোকে স্থানান্তর করা হয় ইনকিউবেটরের হ্যাচার অংশের ট্রেতে। হ্যাচারে ৩৭ দশমিক ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তিন দিনে ডিমের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে সদ্য জন্ম নেয়া লক্ষাধিক মুরগীর বাচ্চা।
হ্যাচারিতে ডিম সরবরাহের জন্যে এখানে আছে সাড়ে এগারো হাজার ধারণ ক্ষমতার দু’টি সোনালী মুরগির খামার। গুণগতমানের ডিম সরবরাহের জন্যে আছে যৌথ উদ্যোগের আরো মুরগির খামার।
হোসনে আরা জানান, হ্যাচারিতে জন্ম নেয়া মুরগির বাচ্চা ৭২ ঘন্টার মধ্যে বাঁশের ঝুঁড়ির মধ্যে সরবরাহ করতে হয়। নাটোর ছাড়াও রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহ জেলার খামারীরা এর ক্রেতা। প্রতিটি বাচ্চার বিক্রি মূল্য ১৮ থেকে ২০ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে মুনাফার পরিমাণ মন্দ নয়। নাটোরের সিংড়া উপজেলা বাজার এলাকার ব্যবসায়ী দৌলত হোসেন নান্টু ১৯ টাকা দরে আট হাজার মুরগীর বাচ্চা কিনলেন। নান্টু বললেন, ‘এই হ্যাচারির মুরগির বাচ্চাগুলোর মান ভালো, অসুখ-বিসুখ কম হয়, তাই ঝুঁকি কম। দীর্ঘদিন ধরে আমি নিয়মিত বাচ্চা নিয়ে এলাকার খামারীদের মাঝে সরবরাহ করছি।’
নাটোরের হোসনে আরার এই সফলতা একদিনে আসেনি। অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে তিনি অর্জন করেছেন এই সমৃদ্ধি। ১০ বছর আগে শুরু করেছিলেন পোল্ট্রি হ্যাচারি। তারও দশবছর আগে পোল্ট্রি খামার।
আলাপচারিতায় হোসনে আরা ফিরে গেলেন দুই দশক আগে। বললেন, ‘শখ করে মাত্র ১০টি মুরগি পালনের মধ্য দিয়ে শুরু করেছিলাম। এরপর ধাপে ধাপে বাড়িয়েছি মুরগির সংখ্যা।’
বস্ত্র ব্যবসায়ী স্বামীর সংসারে অভাব-অনটন না থাকলেও খুব একটা স্বচ্ছলতা ছিল না। চার সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হতো। এরই মধ্যে তিল তিল করে হোসনে আরা মুরগির খামারের পরিধি বাড়িয়েছেন। এক সময় হাল ধরেছেন পুরো সংসারের। হয়েছেন একজন সফল উদ্যোক্তা।
শুরুতে পরিবারের সদস্যরা হোসনে আরার এই উদ্যোগকে সহজভাবে নিতে পারেননি। একসময় তারাও এগিয়ে আসেন হোসনে আরার হ্যাচারির সহযোদ্ধা হিসেবে। তার স্বামী হাফেজ লুৎফর রহমান বলেন, ‘বিরূপ পরিবেশেও ভেঙে পড়েননি হোসনে আরা। হার না মানার কারনেই দুই দশক পরে স্পর্শ করতে পেরেছেন সমৃদ্ধির মাইল ফলক।’
রতœগর্ভা মা হোসনে আরার চারছেলের মধ্যে বড় ছেলে জিশান আইন বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করে মায়ের হ্যাচারী দেখাশোনা করছেন, মেজ ছেলে ইমরান বিসিএস নন ক্যাডার সার্ভিসে চাকরি পেয়েছেন, সেজ ছেলে নাঈম পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে ¯œাতক (সম্মান) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন এবং ছোট ছেলে তানভির ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। কথা প্রসঙ্গে চারছেলেই বললেন, ‘আমাদের পড়াশুনার প্রেরণার উৎস আমাদের মমতাময়ী মা’।
হোসনে আরা যে শুধু নিজের ব্যবসায়ের প্রসার ঘটিয়েছেন তা নয়, খামার ও হ্যাচারিতে তৈরি হয়েছে স্থায়ী ও খন্ডকালীন মিলিয়ে প্রায় ৩০ জনের কর্মসংস্থান। অসংখ্য নারী উদ্যোক্তার জন্য তিনি অনুপ্রেরণা। ওইসব উদ্যোক্তারা খামার স্থাপন করে তাদের সংসারে স্বচ্ছলতা নিয়ে এসেছেন। এ রকমই একজন ঘোড়াগাছা এলাকার খামারি সাজেদা বললেন, ‘হোসনে আরা আপা আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন, আমরা তার কাছে চির কৃতজ্ঞ’।
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের নাটোর শাখায় প্রায় একশ’ নারী উদ্যোক্তার ব্যাংক ঋণের গ্যারান্টার হয়েছেন হোসনে আরা। মাত্র পাঁচ শতাংশ সুদে বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির ঋণ পেয়েছেন তারা। ঋণগ্রহীতা মর্জিনা বলেন, ‘হোসনে আরা আপা গ্যারান্টার হওয়ায় ব্যাংক ঋণ পেয়েছি। ঋণের টাকায় খামার করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছি’।
নাটোর সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোঃ সেলিমউদ্দিন জানান, সততা,অক্লান্ত পরিশ্রম আর অধ্যবসায় হোসনে আরাকে সফলতা দিয়েছে। তিনি আজ নাটোর জেলার সবচেয়ে বড় পোল্ট্রি হ্যাচারির মালিক। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে হোসনে আরার কার্যক্রম সকলের জন্যেই অনুকরণীয় বলে জানালেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বেলাল হোসেন।
হোসনে আরার হ্যাচারি পরিদর্শন শেষে নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, ‘হোসনে আরা শুধু নিজে সফল উদ্যোক্তা নন, তিনি অসংখ্য উদ্যোক্তা তৈরি করে যাচ্ছেন। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।’
নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে হোসনে আরা বললেন, ‘এখনো অনেক দূরে যেতে হবে। এন্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগি পালনে সফলতা অর্জনের চেষ্টা করছি। নিরাপদ ডিম ও মাংস উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানিরও লক্ষ্য আছে।’