বাল্য বিবাহ আরো কমিয়ে আনতে হবে

1104

॥ তাসলিমা সুলতানা ॥
ঢাকা, ২৩ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : মাত্র ১২ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া সালমা আক্তারের। বিয়ের পর জানতে পারে স্বামী আবার মাদকাসক্ত। বছর ঘুরতেই মা হতে যাওয়া… এরপর গর্ভপাত।
সন্তান জন্ম দিতে না পারার ‘কলঙ্ক’ নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিধবা মায়ের সংসারে ঠাঁই হওয়া! এখন সালমার বয়স ১৬ বছর। অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে সে। এর মধ্যে তার আরও একটি বিয়ে হয়, সেই সংসারে সন্তানও রয়েছে দু’টি।
সালমার মতো ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল হাফসারও। তারও প্রথম সন্তান নষ্ট হয়েছিল গর্ভাবস্থায়। বয়স ১৭ বছর হতেই তার ঘরে আসে দুই মেয়ে। তার স্বামী স্বপন মিয়াও একজন মাদকাসক্ত, কখনও কখনও মাদক বিক্রিও করে; যার জন্যে জেলও খাটতে হয়েছে কয়েকবার। তবে মাদক মামলায় গত দুই বছর ধরে জেলে। এ অবস্থায় দুই সন্তান নিয়ে চার দিকে অন্ধকার দেখছে হাফসা।
রাজধানীর অন্যতম জনবহুল কড়াইল বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, শুধু সালমা কিংবা হাফসাই নন তাদের মতো আরও অনেক কিশোরীর জীবনেই ‘অভিশাপ’ নিয়ে এসেছে এই বাল্যবিয়ে।
নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকার বাল্যবিয়ে বন্ধে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর সুফলও পাওয়া গেছে। তবে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষের মধ্যে এখনো বাল্য বিবাহের প্রবণতা রয়ে গেছে।
বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের বস্তিতে বসবাসকারী ও দরিদ্র পরিবারগুলোর চিত্র প্রায় একই। জানা যায়, দরিদ্রতার পাশাপাশি কুসংস্কার, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামির প্রভাবে ছেলে-মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন এসব পরিবারের অভিভাবকরা। এর মধ্যে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেও দায়ী করছেন অনেকে।
হাফসার মা সেনুয়ারা খাতুন বলেন, ‘মাইয়ার বাবা নাই। কিন্তু বড় হইছে, এলাকার বখাটেরাও নানাভাবে ঝামেলা করে। তাই বিয়া দিছিলাম। কিন্তু এই বিয়া যেনো আমার জন্য কাল অইয়া দাঁড়াইছে।’
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, বিশ্বে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে সামনের কাতারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এর মধ্যে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রায় ৭০ কোটি মেয়েরই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শৈশব পেরোতে না পেরোতেই। অর্থাৎ আঠারোয় পৌঁছানোর আগেই সংসার জীবনে পা রাখতে হচ্ছে এই কিশোরীদের। তার মধ্যে ২৫ কোটিকেই সংসার জীবনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ১৫ পেরোনোর আগে।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাল্যবিয়ের কারণে দেশে গর্ভপাতও হচ্ছে। আর এটি বহু নারীর জীবনেই আনছে নানা ব্যাধি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিশোরীদের গর্ভপাত ঘটানো হয় অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। অপুষ্টি ও গর্ভধারণজনিত জটিলতায় পৃথিবী থেকে অনেককে বিদায়ও নিতে হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান বলেন, বাল্যবিয়ে একটি মেয়েকে বিয়ে বা সাংসারিক জীবনের অর্থ বুঝে ওঠার আগেই তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে দেয়। বঞ্চনা, লাঞ্ছনা তাদের অনেককে শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথেও ঠেলে দিচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণা তথ্য বলছে, পুষ্টির সঙ্গে স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যের সঙ্গে বাল্যবিয়ের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কিশোরী অবস্থায় কোনো মায়ের পুষ্টিগতমানের ওপর তার দেহে বেড়ে ওঠা ভ্রুণের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয়। ১৮ বছরের নিচে কিছুতেই সন্তান জন্ম নিরাপদ নয়। ফলে অনেক সময় শিশুর, এমনকি মায়েরও মৃত্যু হয়।
মা ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করা ডা. নাজনীন আক্তার বলেন, অল্প বয়স্ক মেয়ের মা হওয়ার কারণে শারীরিক সক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ হয় না, তাই বিবাহিত নাবালিকারা প্রায় সবাই সন্তান সম্ভবা অবস্থায় বা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সের এক তৃতীয়াংশ কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হয়। জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার ২০০৯ সালে ছিল ৬৪ শতাংশ, ২০১০ সালে ৬৬ শতাংশ, ২০১১ সালে ৬৪.৯ শতাংশ। তবে ২০১৪ সালে কমে ৫৮.৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
আর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের ২০১৭ সালের জরিপে বলা হয়েছে, এ হার ৪৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর ৩ মাস।
যোগাযোগ করা হলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) কাজী রওশন আক্তার জানান, বস্তি এলাকায় বাল্যবিয়ে সব চেয়ে বেশি হচ্ছে। দরিদ্রতার কারণে অভিভাবকরা তাদের কন্যাশিশুর বয়স ১২-১৩ পার না হতেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। ফলে অধিকাংশ সংসার টিকছে না।
তবে এখন সেটা আগের তুলনায় অনেকটা কমেছে বলে জানান তিনি।