পার্লার ব্যবসার মাধ্যমে ডেইজির এগিয়ে যাওয়ার গল্প

1215

॥ আবিদা হক লোরা ॥
ঢাকা, ২০ নভেম্বর ২০১৮ (বাসস) : উন্নয়নশীল বাংলাদেশে এখন নারী পুরুষ সবাই সমান। সকলেই অবদান রাখছেন দেশের উন্নয়নে। অর্থাৎ সকলে এখন রোজগার করছে। সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও মানুষ স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই নারী সমাজও। এক সময় দেশের নারী সমাজ নানা বৈষম্যের শিকার হলেও সমাজে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে মহিলারা যুগান্তরকারী পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখছে। একটা সময় ছিল কোনো কাজ করতে গেলে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। তবে আশার আলো এই যে, বর্তমানে নারীরা বিভিন্ন বাধাবিপত্তি পেরিয়ে নিজেদেরকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করছেন। বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে পার্লার প্রতিষ্ঠা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে। বেশ ভাল সারাও পাচ্ছেন অনেকে। তবে এই ব্যবসায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একক মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত বিধায় নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে নারীদের। এখনো তারা বিভিন্ন সামাজিক, আর্থিক, মূল্যবোধ এবং সব থেকে বড় যে সমস্যাটি তারা মুখোমুখি হচ্ছেন তা হলো ব্যবসায় প্রসার করতে যথাযথ প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞ কর্মচারী এবং উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবঘটিত সমস্যা। কিন্তু তারপরও থেমে নেই নারীরা। তাদেরই একজন ডেইজি। পুরো নাম শিরিন আক্তার ডেইজি।
বরিশালের মেয়ে ডেইজি (৩৮) পড়াশোনায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। অল্প বয়সেই বাবা-মা তাকে বিয়ের পিড়িতে বসান। ছোটবেলা থেকেই তার প্রবল আগ্রহ ছিল নিজে কিছু একটা করবেন। যেহেতু পড়াশোনা তেমন একটা করা হয়ে উঠেনি তাই চাকরি করার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবলেন। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে ২০০৬ সালে তিনি একটি পার্লার দেয়ার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে মালিবাগের একটি পার্লারে কাজ শেখা শুরু করলেও সংসার এবং বাচ্চা দেখাশোনা করার জন্য বেশিদিন সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। কয়েক মাস পর ইস্কাটনের শাহিন’স পার্লারে ত্রিশ হাজার (৩০,০০০) টাকা দিয়ে তিন মাসের একটি প্রশিক্ষণ নেন তিনি। পরে সেখানে বেশ কিছুদিন কাজও করেন তিনি। এ ভাবে ছয় মাস কাজ করার পর নিজেই বাসার ভিতর একটা রুমে দুইটা চেয়ার আর একটা বেড দিয়ে শুরু করলেন বিউটি পার্লার ব্যবসা। মাত্র বিশ হাজার টাকা দিয়ে তার প্রথম ব্যবসার পথচলা। ধীরে ধীরে যখন কাস্টমার আসা শুরু করল তখন চিন্তা করলেন কিভাবে পার্লারটাকে আরও বড় পরিসরে সাজানো যায়। ২০০৯ সালে কাঁঠাল বাগানে এসে তিনি নিজস্ব সাইনবোর্ড দিয়ে এবং পার্লারের নাম সরকারি খাতায় নিবন্ধন করে বড় করে খুললেন নতুন পারলার। পার্লারের নাম রাখেন ‘স্টাইল বিউটি পার্লার এন্ড বিউটি শপ’। পার্লারের পাশাপাশি তিনি মহিলাদের বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীও দোকানে রাখা শুরু করলেন। তিনি বিভিন্ন ট্রেইনারদের কাছ থেকে ট্রেনিং নেন। এর মধ্য চায়না এবং ইন্ডিয়া থেকে আগত মেকাপ আর্টিস্টদের শিক্ষানবিশ ছিলেন তিনি। তাছাড়া কাকলি ব্যানার্জি নামে একজন থেকে ফেসিয়ালের উপরও প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এসব প্রশিক্ষন নিতে তাকে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে এবং এর জন্য বেশ কিছু সনদও পেয়েছেন তিনি।
তবে এতকিছু কিন্তু ডেইজির জন্য খুব একটা সহজ ছিল না। পরিবার থেকে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। ডেইজি বলেন, “আমি যখন নিজের একটা পার্লার করার উদ্যোগ গ্রহণ করি তখন আমার পরিবার এমনকি আমার স্বামীর কাছ থেকেও আমি বাধা পাই। তার মতে পার্লারে কাজ করলে মহিলারা খারাপ হয়ে যায়। আমাকে এই কাজের জন্য টাকা দিতেও আপত্তি জানান তিনি। আমি আমার ভাইর কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করি। কিন্তু বর্তমানে আমার স্বামী আমাকে সব ধরনের সহায়তা করেন এবং আমার কাজে আমাকে উৎসাহ দেন। সংসারের সব কাজেও আমার পাশে থাকেন তিনি। পুরো পরিবারই এখন আমার এই কাজ নিয়ে গর্ব করে।”
ডেইজি এখন পার্লারের পাশাপাশি বুটিক্স দিয়েছেন। বুটিক্সের জিনিসপত্র তিনি ইসলামপুর থেকে সংগ্রহ করেন এবং কসমেটিকস আমদানি করেন ভারত থেকে। পার্লার এবং বুটিক্স থেকে তিনি ভালই লাভ পাচ্ছেন। কিন্তু একটি সমস্যার কথা তিনি বলেছেন তা হলো দক্ষ বিউটিশিয়ানের অভাব।
নিজের ব্যবসাকে আরও বড় এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সাজানোর একটি ইচ্ছা ব্যক্ত করেন তিনি। তার মতে, “নতুন উদ্যোগ শুরু করতে পরিকল্পনাই হল বড় বিষয়। পরিকল্পনা সঠিক হলে অর্থের সমস্যাটাকে বড় করে দেখার কিছু নেই”।
সব শেষে তিনি বলেন, ‘সমাজে বাঁধা-বিপত্তি থাকবেই। তারপরও এগিয়ে যেতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং একাগ্রতা থাকলে কোন কিছুই কঠিন নয়। কেবলমাত্র স্বামী কিংবা পুরুষের ওপর নির্ভর না করে পরিকল্পনা মাফিক কাজ করলে দেশের নারী সমাজও হতে পারে আত্মনির্ভরশীল, অবদান রাখতে পারে দেশের অগ্রজাত্রায়।’