হবিগঞ্জের শংকরপাশা মসজিদ ও বিথঙ্গল আখড়াকে পর্যটক বান্ধব করার উদ্যোগ

245

॥ শাহ ফখরুজ্জামান ॥
হবিগঞ্জ, ১৬ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হবিগঞ্জ জেলায় রয়েছে অনেক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। সবকিছু মিলিয়ে হবিগঞ্জ জেলার ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে পর্যটনকে। এবার জেলার দুটি প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন শংকরপাশা শাহী জামে মসজিদ ও বিথঙ্গল আখড়াকে পর্যটক বান্ধব করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। এর জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে।
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক ফজলুল জাহিদ পাভেল জানান, হবিগঞ্জের পর্যটন বিকাশে জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হল শায়েস্তাগঞ্জ থেকে মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর পর্যন্ত সাবেক ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ২৩ কিলোমিটার এলাকাকে গ্রীণ ড্রাইভ নাম করণ করে ১২ প্রজাতির দেশী-বিদেশী সাড়ে ৬ হাজার ফুলগাছ লাগানো হয়েছে। ১২ মাস এখানে ফুল ফুটে নয়নাভিরাম দৃশ্য সৃষ্টি করবে। চা গাছ ও বনাঞ্চলের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি এমনিতেই অপূর্ব। বর্তমানে জেলা প্রশাসন জেলার দুটি ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার শংকরপাশা শাহী জামে মসজিদ এবং বানিয়াচংয়ের হাওর এলাকার বিথঙ্গল আখড়াকে পর্যটক বান্ধব করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তিনি আরও জানান, শংকরপাশা শাহী জামে মসজিদ একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মসজিদ। সুলানী আমলের বর্গাকার এই মসজিদেও দেয়ালের দৈর্ঘ্য ২১ ফুট ৪ ইঞ্জি। মসজিদের সামনের ভাগে রয়েছে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি প্রশস্ত বারান্দা। নান্দনিক ও ঐতিহাসিক এই মসজিদ দেখতে দেশ-বিদেশের প্রচুর দর্শনার্থী আসে। তাদের জন্য প্রস্তাবিত সংস্কার কাজের মাঝে থাকবে মসজিদের গম্বুজ এবং মটিফ সংস্কারসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মসজিদের সামনের রাস্তার উন্নয়ন এবং পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত ওয়াশব্লক এবং পানীয় জলের ব্যবস্থা করা।
তিনি বলেন, বানিয়াচং উপজেলার হাওর এলাকায় অবস্থিত বিথঙ্গল আখড়া রামকৃষ্ণ গোস্বামী ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বৈষ্ণব ধর্মালম্বীদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান। এ আখড়ায় ১২০ জন বৈষ্ণব রয়েছে। প্রায় ৫শ বছর পূর্বে ত্রিপুরার রাজা উচ্চবানন্দ মানিক্য বাহাদুর এ আখড়ায় দুটি ভবন নির্মাণ করেন। প্রাচীন নির্মাণ কৌশল সমৃদ্ধ ভবনগুলো দেখতে প্রচুর পর্যটক আসেন এখানে। সরকারের কাছে এই আখড়ার ভবনের অবকাঠামো সংস্কার, আখড়ার সামনের রাস্তা সংস্কার, পর্যটকদের বিশ্রাম এবং আখড়ায় রাত্রিযাপনের জন্য রেস্ট হাউজ নির্মাণসহ পর্যটকের পানীয় জল এবং ওয়াশব্লকের ব্যবস্থা করার জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হচ্ছে।
হবিগঞ্জ জেলার সদরের রাজিউড়া ইউনিয়নের শংকারপাশা গ্রামে অবস্থিত শাহী জামে মসজিদকে এলাকাবাসী গায়েবী মসজিদ নামে অভিহিত করে। অনেকেই মনে করেন এই মসজিদটি গায়েবীভাবে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে ইতিহাসবিদদের মতে মসজিদটি নির্মাণ করেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মজলিশ আমিন। উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা গেছে ১৫১৩ সালে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদের পাশে রয়েছে হযরত মজলিশ আমিন (র:) এর মাজার। এ মাজারে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন মান্নত নিয়ে আসে। বাংলায় বিশেষ করে সুলতানী আমল ও মোঘল আমলে নির্মিত হয় বহু মসজিদ। বৃটিশ আমলে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মসজিদগুলো বেহাল দশায় পতিত হয়। ইংরেজদের অত্যাচারের শিকার হয় মুসলমানরা। এক সময় ওই মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় বিরান ভূমিতে পরিণত হয়ে জংঙ্গল বেষ্টিত হয়ে পড়ে। মুসলমানদের জাগরণকালে এলাকাগুলোতে বসবাস শুরু হয় আবার। জঙ্গলগুলো আবাদ করতে গিয়ে বের হয়ে আসে অনেক মসজিদ। এর মধ্যে উচাইল জামে মসজিদটি ছিল। তার পর থেকে লোকজন মসজিদটিকে গায়েবী মসজিদ বলে প্রচার করে। বর্তমানে মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। এটি রক্ষণাবেক্ষণের বড় অভাব দেখা দিয়েছে।
এই এলাকার সন্তান ও সরকারের উপ-সচিব আজিজুর রহমান শামীশ বলেন, এই মসজিদটিকে রক্ষা করতে হবে। এটি যেমন নান্দনিক তেমনিভাবে ঐতিহাসিক স্থাপনা। বহু লোকজন আসে মসজিদটিকে দেখতে। প্রশাসন থেকে এই মসজিদকে পর্যটকবান্ধব করার উদ্যোগ নেয়ার কথা জেনে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
এদিকে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার পৈলারকান্দি ইউনিয়নের শ্রীমঙ্গলকান্দি গ্রামে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নিদর্শন বিথঙ্গল আখড়া। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জগন্মোহনী সম্প্রদায়ের তৃতীয় মঠ বিথঙ্গল আখড়ার বিশাল ইমারতগুলোর আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলী সহজেই দর্শকদের আকৃষ্ট করে।
হবিগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিথঙ্গল আখড়া। আখড়ার মোহন্ত সুকুমার দাশ গোসাই জানান, জগন্মোহনী সম্প্রদায় একটি নয়া ধর্ম সম্প্রদায়। প্রায় সাড়ে ৪শ’ বছর আগে হবিগঞ্জ অঞ্চলে এর উৎপত্তি ঘটে। এ সম্প্রদায়ের প্রবর্তক শ্রী শ্রী জগন্মোহন গোস্বামী। তিনি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার বাঘাসুরা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তিনি মাত্র ৩১ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর সমাধিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে মন্দির। তিনি ছিলেন আখড়ার প্রথম মোহন্ত বা মঠাধ্যক্ষ। এটি জগন্মোহনী সম্প্রদায়ের তৃতীয় মঠ হলেও সামাজিক প্রভাব প্রাচুর্য্যরে দিক দিয়ে এটি প্রধান স্থান দখল করে আছে। এক সময় এখানে ১২০ জন বৈষ্ণব ছিলেন। এখানে বৈষ্ণবী থাকার বিধান নেই। সাধুরা নিরামিষভোজী ও স্ত্রী-সঙ্গ বর্জনকারী। ১২০ জন বৈষ্ণবের বসবাসের জন্য এখানে আলাদা আলাদা কক্ষ রয়েছে। বৈষ্ণবরা একত্রে স্নান করতেন। তাদের একত্রে স্নান করার জন্য আখড়ার পাশে সুদীর্ঘ শান বাঁধানো ঘাট ভগ্নদশায় আজো বিদ্যমান। আখড়ার অনেক দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে রয়েছে ১ হাজার কেজি (১ টন) ওজনের শ্বেত পাথরের চৌকি, পিতলের সিংহাসন, রথ, রৌপ্য নির্মিত পাখি, মুকুট ইত্যাদি। আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সমাধিস্থলের উপর একটি সুদৃশ্য মঠ রয়েছে। মঠের সামনে রয়েছে একটি নাটমন্দির, ভান্ডার ঘর ও ভোগ মন্দির। আখড়ার মোহন্ত সুকুমার দাশ গোসাই বলেন, আখড়ার নিজস্ব ৪০ একর জমির উৎপাদিত ফসল ও ভক্তদের দানে যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা হয়। সরকার এখানে সংস্কার প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে শুনে তিনি আনন্দিত।
কথিত আছে, আগরতলা মহারাজ কৃষ্ণ কিশোর মানিক্য বাহাদুর তার রাণীকে নিয়ে প্রতিবছর বিথঙ্গল আখড়ায় আসতেন। তিনি এখানে দু-একদিন অবস্থান করতেন। মহারাজ যে চৌকিতে ঘুমোতেন সেটি এখনো সযতেœ রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। আখড়ায় পালিত উৎসবাদির মধ্যে রয়েছে কার্ত্তিক মাসের শেষদিন ভোলাসংক্রান্তি কীর্ত্তন ও ফাল্গুন মাসে পূর্ণিমা তিথিতে দোল পূর্ণিমার ৫ দিন পর পঞ্চম দোল উৎসব। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে ভেড়ামোহনা নদীর ঘাটে ভক্তরা স্নান করেন। স্নানঘাটে বারুনি মেলা ও আষাঢ় মাসে দ্বিতীয় রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি উৎসবে হাজার হাজার ভক্ত যোগদান করেন।