তেঁতুলিয়ার পাথরভাঙ্গা নারী শ্রমিকেরা আশানুরূপ স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন না

973

॥ এম আর পাটোয়ারী ॥
ঢাকা, ১৩ নবেম্বর ২০১৮ (বাসস) : দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। সেটা অঞ্চল বিশেষে নয়, গোটা দেশ জুড়েই। এক সময় উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গায় ক্ষুধা-দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী, উন্নয়নের জোয়ারে তাদেরও ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে। সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে মানুষের দারিদ্র্য ছিল প্রকট। এখন আর তা নেই। সেখানে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান চা চাষ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করছে। এছাড়াও পাথরভাঙ্গা ও পাথর উত্তোলন শ্রমজীবী মানুষের আয়ের পথ করে দিয়েছে। এই দু’টি খাতে নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি।
তেঁতুলিয়া থেকে বাংলা বান্ধার দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। এই সড়কের দু’পাশে শুধু পাথর আর পাথর। মহানন্দা নদী থেকে পাথর উত্তোলন করছেন শত শত মানুষ, তাদের একটা অংশ নারী। মাটির নিচ থেকে পাথর উত্তোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছেন।
ভারত ও নেপাল থেকে আমদানিকৃত পাথর প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। অন্যদিকে তেঁতুলিয়া থেকে ভজনপুর পর্যন্ত পাথরের কায়-কারবার গড়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবী মানুষের অর্ধেকই নারী। পুরুষের পাশাপাশি তারা পাথরভাঙ্গা ও পাথর প্রক্রিয়াকরণের মতো কঠিন কাজ করে যাচ্ছেন।
পঞ্চগড় পাথর তোলা ও মাটি কাটা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোকতারুল হক মুকু জানান, পঞ্চগড় এলাকায় ১ হাজারেরও বেশি ছোট-বড় পাথর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিকই বেশি। তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছেন। কিন্তু আর্থিকভাবে তেমন একটা সুবিধা পাচ্ছেন না। তারা মজুরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। অপুষ্টিতে ভুগতে হচ্ছে। উপরন্তু স্বাস্থ্য সেবা মিলছে না।
তেঁতুলিয়ার সর্দারপাড়ার সামিনা বেগম জানান, ৫ বছর ধরে পাথর প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। স্বামী মারা যাবার পর এ কাজে আসতে হয়। দুই মেয়ে এক ছেলে। জোতজমি বলতে কিছু নেই। এখানে কাজ করে সবার জীবন চলছে। কিন্তু তা অনেক কষ্টে। দিনমজুরি পান মাত্র ২শ’ টাকা। এ দিয়ে সংসার চলে না। অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে।
সাহেবজোর থেকে পাথরভাঙ্গার কাজ করতে আসা সালেহা খাতুন জানান, তার স্বামী অসুস্থ। আগে ভ্যান রিকশা চালাতেন। এখন আর পারেন না। নিরুপায় হয়ে তাকে এ কাজ নিতে হয়েছে। শরীর ভাল যাচ্ছে না। এরপরও বাধ্য হয়ে এ কাজ করতে হচ্ছে। কাজ না করলে বিপদ। ছেলেমেয়েসহ উপোস থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সামিনা, সালেহার মতো ছবিরন, ফাতেমা, লাইলী, আছিয়াও পাথরভাঙ্গার কাজ করছেন। কঠিন কাজ করতে গিয়ে খুব ধকল যাচ্ছে। অনেকে নানারকম রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত। স্বাস্থ্য সেবার কোনো বালাই নেই।
পঞ্চগড় জেলার সিভিল সার্জন ডা. নিজাম উদ্দিন জানান, যারা পাথর উত্তোলন এবং পাথরভাঙ্গার কাজ করেন, তাদের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যারা পাথরভাঙ্গার কাজে ব্যাপৃত রয়েছেন, তাদের কাশি, হাঁপানি, অ্যাজমার মতো রোগে ভুগতে হয়। পাথরের কণা ধূলা-বালি হিসেবে তাদের শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশ করায় সিলিকোসিস রোগ হয়। তখন ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্রম হ্রাস পায়।
জরিপে দেখা গেছে, লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম ও বুড়িমারীতে পাথরভাঙ্গা নারী ও পুরুষের মাঝে সিলিকোসিস রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। কিন্তু তেঁতুলিয়ায় পাথরভাঙ্গা শ্রমিকদের ওপর এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা কোনো জরিপ চালানো হয়নি। সিভিল সার্জন আরো বলেন, শ্রমিকেরা একটু সচেতন হলে এসব রোগ থেকে অনেকাংশে মুক্তি পেতে পারেন। বিশেষ করে কাজের সময় মাস্ক ব্যবহার করলে তারা অনেকটা মুক্ত থাকতে পারেন।
তেঁতুলিয়া উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুলতানা রাজিয়া জানান, এ উপজেলায় পাথর উত্তোলন ও পাথরভাঙ্গা কাজের প্রসার ঘটেছে। নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। প্রায় ৫০ হাজার নারী কাজ করেন। এরা শুধু তেঁতুলিয়া উপজেলার নন। অন্যান্য এলাকা থেকেও অনেকে আসেন। জীবন ধারণের জন্য এসব কঠিন কাজ করতে বাধ্য হন। কিন্তু তারা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। নারীরা এসব কাজে দিনপ্রতি পারিশ্রমিক পান ২শ’ টাকা। পুরুষদের সাথে মিলিয়ে দিলে তখন পান ৩শ’ টাকা। অপরদিকে পুরুষ শ্রমিকরা পান ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা পর্যন্ত। তিনি জানান, নারী শ্রমিকরা স্বাস্থ্যসেবা তেমন একটা পান না। দুর্ঘটনায় পড়লে বা অসুস্থ হলে উপজেলা উন্নয়ন তহবিল থেকে তাদের সহযোগিতা করা হয়। কোন নারীশ্রমিক কর্মস্থলে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে মালিকেরা একটু-আধটু সহযোগিতা করেন। পাথরভাঙ্গা এবং পাথর উত্তোলনের মতো কঠিন কাজের জন্য তাদের ন্যূনতম যে পুষ্টির প্রয়োজন, সেটা তারা পান না। প্রয়োজন মাফিক কোনো স্বাস্থ্য সেবাও নাগালে নেই। এর ফলে তারা নানা রকম রোগ ব্যাধির শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক শ্রম জরিপ অনুযায়ী শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ৯৮ লাখ। এ সংখ্যা কখনো বাড়ে, আবার কিছুটা কমেও। তবে এটা সত্য যে, গ্রামীণ নারীরা প্রয়োজনের তাগিদেই ঘরের বাইরে আসছেন। তারা কৃষি থেকে শুরু করে সর্বস্তরে শ্রম দিচ্ছেন। এতে একদিকে তাদের আর্থিক সংকট দূর হচ্ছে। পাশাপাশি দেশে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ছে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ গার্মেন্টস সেক্টর। এ সেক্টরের সিংহ ভাগ শ্রমিকই নারী। এই খাত থেকে দেশের ৭৮-৮২ ভাগ রফতানি আয় অর্জিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, বাংলাদেশের নারীরা দেশের অমিত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছেন। কিন্তু হলে কি হবে। নারী শ্রমিকেরা মজুরির দিক থেকে বৈষম্যের শিকার। নানা রকম বঞ্চনা ও নিপীড়ন সয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় পাথর উত্তোলন ও পাথরভাঙ্গার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তারা আর্থিক বৈষম্যেও অসহায় শিকার। তাদের স্বাস্থ্যসেবার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ায় নানা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এজন্য পাথরভাঙ্গা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।