পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে

1096

॥ এম আর পাটোয়ারী ॥
ঢাকা, ১২ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : সম্প্রতি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজার ইউনিয়নের মহাদেবপুর গ্রামে পানিতে ডুবে ৩ শিশুর করুণ মৃত্যুর খবর। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাজিপুর ইউনিয়নের ইকরগাছা গ্রামে পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে ২ শিশু।
এমন খবর প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে দেখা যায়। পানিতে ডুবে শিশুদের মারা যাওয়ার সব খবর কি জানা যায়? না। যদিও তথ্যপ্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি হয়েছে দেশে। কিন্তু অনেক প্রত্যন্ত এলাকা এখনো পর্যন্ত এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে দেশের নদী-সাগরের উপকূলীয় বা দুর্গম চর এলাকা এবং দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রবেশ করলেও এর প্রসার ঘটেনি। ফলে অনেক খবর অগোচরেই থেকে যায়।
আইসিডিডিআরবি ও যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪টি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশে প্রতিদিন ৪০টি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ খবর সংবাদ মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে আসে না। তাই এভাবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টির তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে- দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, যা মোট শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশ। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। হাম, পোলিও, হুপিং কাশি, ধনুষ্টঙ্কার, ডিপথেরিয়া ও যক্ষ্মাজনিত কারণে মৃত্যুর যে সংখ্যা, তার চেয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ইউনিসেফের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু একটি গোপন মহামারী।
উল্লিখিত জরিপে প্রতিবছর ১৫ হাজার শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুর কথা বলা হলেও সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) তথ্য অনুযায়ী- প্রতিবছর ১৮ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে।
এসব তথ্য অবশ্যই হতাশাজনক। দেশে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে। পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুহার সে সফলতাকে ম্লান করে দিচ্ছে। শিশু স্বাস্থ্য গবেষকরা মনে করেন, সহ¯্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করতে হলে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে হবে। প্রতিবছর যে সংখ্যক শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে তাতে এমডিজি অর্জনের গতি কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। দেশের চারদিকে নদী আর খাল বিল। বর্ষাকালে প্লাবিত হয় দেশের ব্যাপক এলাকা। আরো আছে বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে অনেক মানুষের সলিল সমাধি হয়। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি। দক্ষিণাঞ্চলে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার বেশি। বরিশাল বিভাগে বেশি। ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সেখানে পানিতে ডুবে মারা গেছে ৩ হাজার ১৫৫ জন। বেশিরভাগই শিশু।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ সম্প্রতি এক সেমিনারে এ তথ্য তুলে ধরে। সংস্থাটি বরিশাল বিভাগের ২৪ উপজেলায় পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে জানায়, সর্বাধিক ৬৭ শতাংশ মৃত্যুই হয়েছে পুকুরের পানিতে ডুবে এবং তা বাড়ির ১০০ মিটারের মধ্যে। বিশেষত জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। এ সময়ে পুকুরে পানি ভরা থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে ৬৩ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটে সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে। এ সময়টাতে মা-বাবা বিভিন্ন গৃহস্থালি কাজে বা অন্যত্র ব্যস্ত থাকেন। ফলে শিশুদের তারা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না।
প্রচলিত ধারণা হলো, নদী ও সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু বেশি হয়। সেখানে পূর্ণিমায় জোয়ারের পানি স্ফীত হয়, আবার ভাটাও হয়। এতে শিশু মারা যায়। আবার জলোচ্ছ্বাসে শিশুর মৃত্যু ঘটে। কিন্তু আগের মতো অবস্থা আর নেই। এসব এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর হার কমেছে। এখন শিশুরা পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায় ৬৭ শতাংশ। সারাদেশেই শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বাড়ির লাগোয়া নিরাপদ পুকুর- ডোবা-খাল বর্ষায় বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিতে ডোবার পর ফুসফুসে পানি ঢুকে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। এরপর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে শিশু মারা যায়। কেননা, অক্সিজেনের অভাবে শিশুরা দ্রুত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এসময় দরকার দ্রুত সম্ভব শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতিস্থাপন করা।
আইসিডিডিআর ও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুরোধ সম্পর্কিত গবেষণায় বলা হয়, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনাতার অভাবে বেশিরভাগ শিশু মারা যায়। তাই সবার আগে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি দরকার।
সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলার কয়েকটি উপজেলায় বেসরকারি উদ্যোগে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র চালু করে সুফল পাওয়া গেছে। গাইবান্ধায় জীবিতা নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এ নিয়ে কাজ করছে। এই সংস্থাটি শিশুদের হাতে একটি বিশেষায়িত বেল্ট (ঘড়ির মতো) পরিয়ে দেয়। পানির স্পর্শে যা বেজে ওঠে। তখন আশপাশে যারা থাকেন, তারা সতর্ক হতে পারেন। সাঁতার কার্যক্রম, প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং গ্রামভিত্তিক ইনজুরি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে বিভিন্ন জরিপ প্রতিবেদনে।
ইউনিসেফের পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে শিশুদের সাঁতার শেখানো, বাড়ির কাছের পুকুর ঘিরে রাখা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। সুফল পাওয়া গেছে এতে।
আজকের শিশুরাই ভবিষ্যতের নাগরিক। তাদের একটি বড় অংশ পানিতে ডুবে মারা যাবে, তা অনভিপ্রেত। ১৯৮০ সালে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ৯ শতাংশ। ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৭ শতাংশে। বর্তমানে তা ৪৩ শতাংশ। খুবই আশংকাজনক চিত্র। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারলে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ব্যাপকতা কমবে না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু সৈয়দ মোহাম্মদ হাশিম বলেন, নদীমাতৃক দেশের বন্যাপ্রবণ এলাকায় পানিতে ডুবে যে শিশুর মৃত্যু ঘটে, এটা ঠিক। মৃত্যুহার কমাতে আমাদের সচেতনতামূলক কর্মসূচি রয়েছে। আমাদের কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে এই কর্মসূচির বিষয়টি গুরুত্ব পায়। কোনো শিশু পানিতে ডুবে মারা গেলে তার দাফন-কাফন বা সৎকারের জন্য পরিবারকে ২০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়।