শেরপুরে সিংড়া চাষে কৃষকের ভাগ্য বদল

581

শেরপুর, ১১ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : এই দেশ নদী মাতৃক। সারা দেশে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে হাজারো নদী, খাল, বিল, ডুবা ও পুকুর। চলমান নদীতে প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ ছাড়া ইচ্ছানুযায়ী কোন ফসল চাষ করার উপায় না থাকলেও বদ্ধ জলাশয় তথা খাল, বিল, ডোবা ও পুকুরে বিভিন্ন দেশি মাছ ও পানিফলের সমন্বিত চাষে বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেকেই। কেউ চাষ করে, আবার কেউ ওই ফল বিক্রির ব্যবসার মাধ্যমে বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন।
শেরপুরের নকলা উপজেলায় পানিফল যেমন- সিংড়া, শাপলা, শালুক চাষের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে অনৈক মৎস্যজীবী পরিবার বদ্ধ পানির নিচে মাছ ও উপরে পানি ফল চাষ করে দিন বদল করেছেন। মাছ, সিংড়া, শাপলা, শালুকেই তাদের ভাত-কাপড় তথা জীবন জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়।
উপজেলার দরপট, দশানী, পাঁচকাহনিয়া, কৈয়াকুড়ী, তাতড়াকান্দা, পলশকান্দি, কায়দা, ছতরকোনা, ধামনা, চন্দ্রকোণা, নারায়নখোলা, চড়অষ্টধর, বারমাইশা, শালখা, পিছলাকুড়ী, বিহাড়ীরপাড়, বানেশ্বর্দীসহ জলমগ্ন প্রায় সব এলাকায় মাছ চাষের সাথে বিভিন্ন পানিফল চাষ করা হচ্ছে।
চাষী বাজু মিয়া, আব্দুছ ছাত্তার, আজহারুল ইসলাম ফকির, আব্দুল কাদির, হানিফ উদ্দিন, মোফাজ্জল হোসেন, মিন্টু মিয়া, আলমাছ আলী, সুরুজ আলী ও মোতালেবের মত বেশ কয়েকজন চাষী জানান, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে বীজ বা কাটিং করা গাছ রোপণ করা হয়। তিন মাসেই উৎপাদন শুরু হয়। ত্রৈমাসিক এসব পানিফল (সিংড়া) গাছ থেকে ৪ থেকে ৫ বার ফল তোলা সম্ভব হলেও পানি যত বেশি হয় ফলন তত ভালো হয়। তারা আরও জানান, উপজেলাতে ৩০ থেকে ৪০ জন পাইকারী ও ৮০ থেকে ৯০ জন খুচরা বিক্রেতা রয়েছেন। এই ফল বিক্রি করেই পরিবার পরিজনের ভরন পোষণ করেন তারা।
শেরপুরের বিভিন্ন জলমগ্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে পানিফল চাষ হলেও নকলায় বাণিজ্যিকভাবে পানিফলের চাষ ব্যাপক হারে বেড়েছে। শুধু সিংড়া, শাপলা ও শালুক বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছে উপজেলার ৩ শতাধিক পরিবার। মাছ ও পানিফল বিক্রির জন্য খাল-বিলের পাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অস্থায়ী বাজার। স্থানীয় বাজারে এইসব ফল খুচরা ও পাইকারী হিসেবে প্রচুর বিক্রি হচ্ছে।
চাষীদের দেওয়া তথ্যমতে, এক কাঠা (৫ শতাংশ) জমিতে সিংড়া চাষ করে বিক্রি পর্যন্ত চাষীদের ব্যয় হয় এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা। ব্যয় বাদে এক কাঠা জমি থেকে গড়ে লাভ হয় ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা। আর সিংড়ার নিচে চাষ করা দেশীয় মাছ বিক্রি করে আয় হয় কমপক্ষে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। তারা জানান, প্রতিটি সিংড়া গাছ থেকে এক মৌসুমে ৪ থেকে ৫ বার ফলন পাওয়া যায়। এতে প্রতি কাঠাতে ৮ থেকে ১০ মণ করে সিংড়া হয়। প্রতি মণ সিংড়ার বর্তমান পাইকারী মূল্য ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা। সে হিসাব অনুযায়ী প্রতি ৫ শতাংশ জমি থেকে এক মৌসুমেই ৪ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকার সিংড়া বিক্রি করা যায়।
সিংড়ার ইংরেজী নাম ডধঃবৎ পযবংঃহঁঃ এবং বৈজ্ঞানিক নাম ঃৎধঢ়ধ হধঃধহং খ । কৃষি বিভাগের তথ্যমতে এটির কোন অনুমোদিত জাত নেই। গরুর মাথার মত এ ফলের ভেতর সাদা শাশযুুক্ত। এই শাশ বেশ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। এটি এলার্জি ও হাত-পা ফোলা রোগের উপশমকারী ভেষজ ওষুধ। তাছাড়া তলপেটের ব্যাথা, পিত্তথলিতে প্রদাহ, উদারাময় ও পোকা মাকড়ের কামড়ে এর শাশের প্রলেপ বেশ উপকারী।
এ বিষয়ে নকলা সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতানা লায়লা তাসনীম জানান, কীটনাশক ব্যবহার ছাড়া দেশীয় মাছ ও পানিফলের সমন্বিত চাষে একদিকে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ সংরক্ষণ হচ্ছে, অন্যদিকে মৎসজীবীরা দ্বিগু। হারে লাভবান হচ্ছেন। দেশীয় মাছকে বিলুপ্তের হাত থেকে রক্ষা করায় নকলা উপজেলার মৎস্য চাষী হিসেবে সরকারি পরিচয়পত্র বহনকারী ২ হাজার ২৪০ জন মৎসজীবী হতে পারে দেশের রোল মডেল।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস জানান, নকলায় তুলনামূলক খালের পরিমাণ কম থাকলেও ১১টি বিল, ১১টি জল মহাল, উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ৫টি নদী, কমবেশী ৪ হাজার ১২০টি পুকুর রয়েছে। তাছাড়া এক হাজার ৬৬৪ হেক্টর নিচু জমি রয়েছে। ওইসব নিচু জমি বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে থাকে। সেইসব জলাবদ্ধ পতিত জমিকে কাজে লাগাতে কাটিং ও বীজ থেকে সিংড়ার চাষ করা সম্ভব। জলাবদ্ধ যেসব জমিতে আমন ধান বা অন্যান্য আবাদ করা সম্ভব না, সেসব জমিতে সিংড়া, শাপলা, শালুক চাষকরে যে কেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।