শিশু শ্রমের অন্যতম কারণ আর্থিক অস্বচ্ছলতা

965

ঢাকা, ৫ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : বাংলাদেশ আজ উন্নয়শীল দেশ। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণেই দেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তারপরও এই বিশাল জনসংখ্যার দেশটিতে এখনো অনেক পরিবারেই রয়ে গেছে আর্থিক অস্বচ্ছলতা। যে কারণেই দরিদ্র পরিবারের কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা শিশু শ্রমে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাতেই এ শিশু শ্রমটা বেশি দেখা যায়। নগরীর খিলগাঁও এলাকায় সারি সারি করে দাঁড়ানো থাকে বেশ কিছু লেগুনা। গন্তব্য দৈনিক বাংলার মোড় আর মালিবাগ। মূলত এই তিনটি স্থানই হচ্ছে লেগুনা স্টেশন। আর এসব লেগুনায় অধিকাংশ হেলপারই হচ্ছে- শিশু এবং কিশোর। এমনকি বেশ কয়েকটি লেগুনার ড্রাইভারও এখনো কিশোর। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যাত্রী উঠানোর জন্য তাদের হাঁক-ডাকে পুরো এলাকা থাকে সরব।
এ সব হেল্পারের একজন করিম। পুরো নাম মো. করিমুল্লাহ। গাড়ির সিরিয়াল আসার সাথে সাথে সেও ব্যস্ত হয়ে পড়ল যাত্রী ডাকতে। গাড়ীতে বসেই কথা হল করিমের সাথে। দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে স্থানীয় এক স্কুলে। তারপরই তার বাবা তাকে স্কুল বাদ দিয়ে টাকা রোজগার করতে বলে। অন্যথায় ভাত বন্ধ। আর তাই বাধ্য হয়েই সে নেমে পড়ে কাজের সন্ধানে। কিন্তু বয়সে ছোট হওয়ায় ভারী কাজ যোগাড় করতে পারেনি। পরে তারই সমবয়সী এক বন্ধুর সহযোগিতায় কাজ নেয় লেগুনাতে। এখন তার দৈনিক আয় ৩০০ টাকা। সকাল আর দুপুরের খাবারের টাকা ড্রাইভার দেয়। ছয় মাস যাবত সে হেল্পারী করছে।
করিম বলে, প্রতিদিন যা পাই সব বাসায় গিয়ে বাবার হাতে তুলে দিতে হয়। আমার আরো ছোট এক ভাই আর এক বোন আছে। বাবা রিকশা চালায়। পড়ালেখার বিষয়ে জানতে চাইলে, করিম বলে, বন্ধুদের স্কুলে যেতে দেখলে খুব খারাপ লাগে। ইচ্ছে হয় তাদের সাথে আমিও যাই। কিন্তু স্কুলে গেলেতো রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এখন সেই চিন্তা বাদ দিয়েছি। এখানেও আমার এখন অনেক বন্ধু আছে।
করিমের মত শাহেদের ঘটনাও প্রায় একই রকম। আরেকদিন কথা হয় শাহেদের সাথে। সে জানায় ক্লাস ফোর পর্যন্ত সে পড়েছে। কিন্তু এরপর এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা মারা যাওয়ায় তাকে নামতে হয় রোজগারে। চার ভাই-বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। তার বড় ভাই তার থেকে মাত্র দেড় বছরের বড়। সেও এখন কাজ করে।
করিম আর শাহেদের মত আরো প্রায় ৭০/৮০ জন শিশু এই দু’টি রুটে লেগুনার হেল্পার হিসেবে কাজ করছে প্রতিদিন। এছাড়াও নগরীর যে সব রুটে লেগুনার চলাচল তার প্রায় সবখানেই কাজ করছে শিশু এবং কিশোররা। মূলত অভাবের তাড়নায় ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে নেমেছে এসব শিশু এবং কিশোররা। অনেক সময় শিকার হচ্ছে মারাত্মক দুর্ঘটনারও।
এ রকম পথ শিশুদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা অপরাজেয় বাংলাদেশ। এই সংস্থার কর্মকর্তা উজ্জ্বল ধর বলেন, মূলত অভাবের তাড়নায় শিশু এবং কিশোররা এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের অনেকের হয়ত বাবা অথবা মা নেই অথবা বাবা-মা কেউ নেই।
তবে শিশু কালেই এই পেশায় জড়িয়ে যাওয়ার ফলে তারা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা থেকে। আবার এখানে বন্ধুদের সাথে মিশে অনেকে হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত। এছাড়াও এসব শিশু এবং কিশোররা এসব কাজে দক্ষ না হওয়ায় শিকার হচ্ছে দুর্ঘটনায়। এমনকি কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে আজীবনের জন্য।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিশু শ্রম আইন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা খুব বেশি কার্যকর নয়। এই আইনে স্পষ্ট করেই উল্লেখ রয়েছে যে, ১৪ বছরের নিচের শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে না। যদিও বর্তমান সরকার শিশুদের যাতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া না হয় সেজন্য অনেক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করেছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে প্রায় অর্ধ লক্ষ শিশু বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত।
মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট মনোয়ারা হোসেন বলেন, শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া মানবাধিকার পরিপন্থী। এ বিষয়ে সরকারও খুব কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তারপরও শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এমনকি প্রতিনিয়ত তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে সরকারের নজরদারী বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে মনোয়ারা বলেন, শুধু সরকারের একার পক্ষে এই শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমাদেরকেও সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি অন্যদেরও সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে শিশুশ্রম বন্ধ হয়।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, আমাদের সরকারের অবস্থান বরাবরই শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে। আর এই লক্ষ্যে আমরা কাজও করে যাচ্ছি। ক্ষেত্রবিশেষে নিয়োগ দাতাদের আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করেছি।
শিশুশ্রম বন্ধে আইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসলে সবসময় আইন দিয়ে সবকিছুর সমাধান হয়না। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা। সবার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। আমরা যখন কোন শিশুকে কাজে নিয়োগ দিই তখন আমাদের নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে যে শিশুটি সেই কাজের জন্য উপযুক্ত কি-না?।
চুমকি বলেন, আমাদের উচিত হবে তাকে কাজে না রেখে, তার বাবা-মাকে বুঝানো। যাতে করে তারা তাদের সন্তানদের কাজে না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠায়। এখনতো স্কুলে পড়ালেখার জন্য কোন খরচই দরকার হয় না। তিনি এ বিষয়ে সরকারের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার জন্য এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখার জন্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।