পার্বত্য চট্টগ্রামে আর কোন সংঘাত নয় : প্রধানমন্ত্রী

939

ঢাকা, ২৮ অক্টোবর ২০১৮ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের স্বার্থে সেখানে শান্তি বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে ভূমি বিরোধ নিরসনে ভূমি কমিশনের কাজে সহযোগিতা করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা পার্বত্য চট্টগামে আর কোন সংঘাতময় পরিস্থিতি চাই না। আমরা চাই এ অঞ্চলের জনগণ যেন ভালো থাকে এবং এখানে শান্তি বজায় থাকে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে রাজধানীর বেইলী রোডে তাঁর নামে নির্মিত ‘শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স’ এর উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
সরকার প্রধান বলেন, একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ না থাকলে কিন্তু উন্নয়ন করা যায় না। একথাটা মনে রাখতে হবে। আজকে সারা বাংলাদেশে যে আর্থসমাজিক উন্নয়ন হচ্ছে তার কারণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। এটা বজায় থাকলেই উন্নয়নটা ত্বরান্বিত করা যায়।’ তিনি বলেন, ইনশাল্লাহ এই ধরনের উন্নয়নের মাধ্যমেই আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারবো।
ইতোমধ্যে তাঁর সরকার পার্বত্য এলাকায় এক হাজার ৬শ’৫৯ কি.মি. রাস্তা নির্মাণ করে দিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিদ্যুৎ দিচ্ছি, যেখনে বিদ্যুতের গ্রিড লাইন নাই সেখানে সোলার প্যানেল করে দিচ্ছি যাতে কোন ঘর অন্ধকারে না থাকে। সব ঘরে যেন আলো জ্বলে।
সকলেই যেন ভাল থাকেন সেই আশাবাদ ব্যাক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আর কোন সংঘাত নয়, সকলেই যেন ভালো থাকেন। যে শান্তিচুক্তি আমরা করেছি সেই শান্তি যেন পাহাড়ে বজায় থাকে।’
তিনি বলেন, ‘শান্তির মধ্যদিয়েই সমৃদ্ধি অর্জন করা যায়। শান্তির পথ ধরেই আসবে প্রগতি। আর প্রগতিই নিয়ে আসবে সমৃদ্ধি। আর এই সমৃদ্ধির পথ ধরেই আমরা জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।’
গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র.আ.ম ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উসে সিংহ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব নুরুল আমিন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন অগ্রগতির ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়।
মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিদেশি কূটনিতিকগণ, উন্নয়ন সয়স্থার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে যা যা করণীয় আমরা তার সবই করেছি। ভূমি নিয়ে যে সমস্যা তারজন্য ভূমি কমিশন করে দিয়েছি। সাধারণ ভূমি অধিগ্রহণ করতে গেলে যে সমস্যাটা হয় অন্যান্য জায়গায় যেভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেভাবে হয় না। তার কারণ মালিকানাটা নিয়ে একটা সমস্যা। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আমি বলবো ব্রিটিশ আমলে কি আইন করে গেছে সেটাকে অনুসরণ না করে আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ তার নিজের ভূমির মালিকানা নিজের নামে যদি পায় তাহলে এই যে সমস্যা-তারা যে ক্ষতিপূরটা পাচ্ছে না, তা তারা পেতে পারেন। ‘কাজেই ভূমি কমিশনকে সহযোগিতা করে তাদের এই ভূমি সমস্যাটির যথাযথ সমাধান যাতে করা যায়, তারজন্য আমি সহযোগিতা চাচ্ছি। কারণ এখানে যতবার কমিশন কাজ করতে গিয়েছে তারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’
পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে সকলেই নিজস্ব অধিকার নিয়ে নিজভূমিতে বসবাস করবেন এটাই তিনি চান উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চাকরী-বাকরীর সকল ক্ষেত্রে আমরা যদিও কোটা প্রত্যাহার করেছি তারপরেও আমার নির্দেশ আছে পিএসসিকে বলে দিয়েছি পার্বত্য অঞ্চল বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যে প্রার্থী থাকবে তারা সবসময় অগ্রাধিকার পাবে। এটা তাঁর সরকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে এবং করে দেবে।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে সকলেই একই দেশের নাগরিক এবং কাউকে এখানে আলাদাভাবে দেখা হয়না উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, সকলের অধিকার সমান।
তিনি বলেন, আমরা ’৯৬ সালে সরকার গঠন করে ’৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করি এবং এর পরবর্তি মেয়াদে আমরা ক্ষমতায় ছিলাম না তাই আমাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়নি। কিন্তু ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই আবার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রায় ২০টা বছর পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ অবহেলিত ছিল। সেখানে যাতায়াত করা যেত না। আমি যখনই সেখানে গেছি বলা হয়েছে ৩টার মধ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শান্তিচুক্তির পরে আর সেই অবস্থাটা নেই। কিন্তু এই ২০ বছরের যে উন্নয়ন হয়নি, ২০ বছরের যে বঞ্চনা সেটা পুরণ করবার জন্যই আমরা বিশেষভাবে বরাদ্দ দিয়ে দিয়ে রাস্তা, ঘাট, পূল ব্রীজ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে নির্মাণ করে দিচ্ছি। সেইসাথে আবাসিক স্কুল পর্যন্ত করে দিচ্ছি যাতে করে সেই দুর্গম পাহাড় বেয়ে ছেলে-মেয়েদের আসতে কষ্ট না হয় এবং সেখানকার মানুষ আরো কিভাবে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। এজন্য তাঁর সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের যেমন প্রকল্প রয়েছে, সেই সাথে তাঁরা স্থানীয়ভাবেও কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, এই ক্ষেত্রেও এখানে যে আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ রয়েছে, তাদেরকেও বলবো স্ব-স্ব অঞ্চলে সার্বিক উন্নয়নে কি কি করণীয় তারজন্য আপনারা নিজেরাও প্রকল্প তৈরী করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনারাও প্রস্তাব আনতে পারেন, যা আমরা বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে বাস্তবায়ন করে দিতে পারবো। যাতে কোনমতেই আর কেউ পিছিয়ে না থাকে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় থানচি ব্রীজ নির্মাণ করতে গিয়ে ‘এটি একটি দুর্গম জায়গা, এখানে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন’ উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর ৬ জন সদস্য নিহত হবার এবং অনেকে আহত হবার কথাও স্মরণ করেন।
পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বর্ডার পোস্টগুলোও তাঁর সরকার নির্মাণ করে দিচ্ছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, একটা যদি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ না থাকে তাহলে কিন্তু উন্নয়ন করা যায় না। একথাটা মনে রাখতে হবে।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভবন নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, এই প্রকল্পটা করে দিয়েছি কারণ এই জায়গাটা আমি নিজেই পছন্দ করেছিলাম। তিনি বেইলী রোড এলাকায় শৈশবে বসবাসের স্মৃতি রোমন্থনে বলেন, ছোটবেলায় এই জায়গাটায় অনেক এসেছি অনেক খেলাধুলা করেছি কাজেই এই জায়গাটা আমি চিনি।
জায়গাটি নেওয়ার জন্য অফিসার্স ক্লাব খুব চেষ্টা করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য তারা মামলা পর্যন্ত করেছিল। সেই মামলা ঠেকিয়ে দিয়ে আমরা জায়গাটি পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর জন্য নিয়েছি।
রাজধানীর মধ্যে এক টুকরো পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়ে তোলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজাইনটা করার সময়ই আমি বলেছি এটা এমনভাবে তৈরী করতে হবে- এই জায়গায় কেউ এসে দাঁড়ালে তারা যেন মনে করতে পারে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামেই এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আমাদের মাঝে কোন দূরত্ব থাকবে না।
তিনি বলেন, এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকজন যারা আসবেন তাঁদের ঢাকায় অবস্থান, বিভিন্ন কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করা, ডরমেটরীর ব্যবস্থা- সবকিছু সুন্দরভাবে করে দেওয়া হয়েছে।
শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা এই জায়গাটিকে আরো সুন্দরভাবে রক্ষনাবেক্ষণে আন্তরিক হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান।
তিনি বলেন, আমরা সবসময় দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বিশ্বাস করি, আর্থসামাজিক উন্নয়নের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবো, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
‘তাই বাংলাদেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যারা যেখানেই আছেন প্রত্যেকেরই উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।