ডেল্টা প্ল্যান ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি : অভিমত বিশেষজ্ঞদের

728

ঢাকা, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮ (বাসস) : নীতি প্রণেতা ও বিশেষজ্ঞরা আজ এখানে এক সেমিনারে সদ্য প্রণীত ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-কে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ‘চাবিকাঠি’ বলে অভিহিত করেছেন। আলোচনায় তারা এই ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও দেন।
জার্নালিস্ট ফর ডেভেলপমেন্ট (জেএফডি) বৃহস্পতিবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ : বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে অর্থনীতিবিদ, প্রকৌশলী, ভূগোলবিদ এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাসহ বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞরা তাদের মূল্যবান মতামত দেন। এসব বিশেষজ্ঞরা দেশে এ ধরনের এই প্রথম পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানের পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সমন্বিত সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারা সর্বোচ্চ সুফল পেতে পানি ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
জেএফডি আহবায়ক এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্য সচিব আবদুল মালেক। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম এবং প্রধান আলোচক ছিলেন পানিসম্পদ, অবকাঠামো ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্ষ ড. আইনুন নিশাত। এছাড়া বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসাবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডীন ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. উম্মে কুলসুম নভেরা।
শামসুল আলম তার মূল প্রবন্ধে বলেন, ডেল্টা প্ল্যানের প্রাথমিক ধাপ বাস্তবায়নে সরকারের ৩৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। এই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ক্রমানুযায়ী বাস্তবায়ন হলে ২০৩০ সাল নাগাদ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি আরো ১ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, ‘ডেল্টা প্ল্যান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বর্তমান প্রজন্মের সেরা উপহার। এটাকে বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্চ বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।’
শামসুল আলম বলেন, ডেল্টা প্ল্যান সরকারের রূপকল্প-২১০০, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে প্রতিনিধিত্ব করে।এতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুপ প্রভাব, প্রবৃদ্ধি, সুনীল অর্থনীতি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) বাস্তবায়নের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ চরম দারিদ্র নির্মূল এবং উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জাতীয় আকাঙ্খা এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নেদারল্যান্ডের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেন। ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এর প্রাথমিক ধাপ বাস্তবায়ন হবে ২০৩০ সাল নাগাদ। এ পরিকল্পনা যাচাই-বাছাই শেষে প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ৮০টি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং গবেষণাবিষয়ক প্রকল্প রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম জানান, ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে ছয়টি স্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।এগুলো হলো-উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবন অঞ্চল, হাওর এবং আকস্মিক বণ্যাপ্রবন এলাকা, পার্বত্যাঞ্চল ও নগর এলাকা। অঞ্চলভেদে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং এর সাধারণ ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
সেমিনারে আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. আইনুন নিশাত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন,পানিখাত দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। বাজেটে এই খাতে বরাদ্দও কমেছে। কিন্তু ডেল্টা প্ল্যানে পানি সম্পদকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থায়ন ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্চ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ডেল্টা প্ল্যানের পানি সংশ্লিষ্ট প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্তকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকায় লবনাক্ততা বৃদ্ধি এবং দ্রুত নগরায়ন সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যা। নীতি-নির্ধারকদের এ বিষয়ের প্রতি বিশেষ নজর দেয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
তথ্যসচিব আব্দুল মালেক বলেন, একুশ শতকে বাংলাদেশ কোথায় যাবে বা দেশকে কোথায় দেখতে চাই-সেটা মাথায় রেখে ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় তিনটি জেলা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনায় জনসংখ্যা কমে গেছে। ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে লবনাক্ততার সমস্যা রোধ করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সেমিনারে বাসসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগামী এক’শ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার যে পরিকল্পনা করেছেন সেটাই মূলত ডেল্টা প্ল্যান। এখন দেশকে এগিয়ে নিতে নাগরিক হিসেবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে।
মাকসুদ কামাল বলেন, বাংলাদেশ সুগঠিত একটি ব-দ্বীপ। নদীমাতৃক এই দেশে পানি ব্যবস্থাপনা এখানে বড় সমস্যা। তাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময়োযোগী বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
ড. উম্মে কুলসুম নভেরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। এজন্য তিনি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নের জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থায়ন প্রয়োজন। এর মধ্যে ২ শতাংশ নতুন বিনিয়োগ এবং শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় করতে হবে। জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ সরকারি তহবিল হতে এবং শতকরা ২০ ভাগ বেসরকারি খাত থেকে আসবে। প্রাথমিক পর্যায়ে বড় শহরগুলোতে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা খাতে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় আদায়ের ক্ষেত্রে এ নীতিমালা কার্যকর করার চেষ্টা করা হবে এবং তা পর্যায়ক্রমে সময়ের আবর্তনে অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হবে।