বাসস প্রধানমন্ত্রী-১ (১ম কিস্তি) : মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের চুক্তি অবিলম্বে বাস্তবায়নের তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর

343

বাসস প্রধানমন্ত্রী-১ (১ম কিস্তি)
শেখ হাসিনা-জাতিসংঘে ভাষণ
মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের চুক্তি অবিলম্বে বাস্তবায়নের তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর
নিউ ইয়র্ক, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ (বাসস): প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের চুক্তির অবিলম্বে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে তাই, এর সমাধানও হতে হবে মিয়ানমারে।’
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে আমরা তারও আশু বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা দেখতে চাই। আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সন্ধ্যায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে একথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে আশ্রয় প্রদান করেছে, যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশ সাধ্যমত তাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, নিরাপত্তা এবং শিশুদের যতেœর ব্যবস্থা করেছে।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় প্রথম থেকেই আমরা তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার-এর মধ্যে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।’
‘তবে, মিয়ানমার মৌখিকভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তারা কোন কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না,’ -বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী বিপুল সংখ্যক নিপীড়িত ও রোহিঙ্গার মত নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আমার হৃদয়কে ব্যথিত করে। এ জাতীয় ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের দেশের মানুষের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল মিয়ানমারের ঘটনা সে কথাই বার বার মনে করিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে ৯ মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানীরা ৩০ লাখ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। ২ লাখ নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। এক কোটি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন,‘ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যে বিবরণ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাতে আমরা হতভম্ব।’
‘একজন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশাকে আমরা যেমন অগ্রাহ্য করতে পারি না, তেমনি পারি না নিশ্চুপ থাকতে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও অবিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা যতদিন তাঁদের নিজ দেশে ফেরত যেতে না পারবেন, ততদিন সাময়িকভাবে তাঁরা যাতে মানসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বসবাস করতে পারেন, সে জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রেখে আমরা নতুন আবাসন নির্মাণের কাজ শুরু করেছি।
তিনি এক্ষেত্রে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা যারা সহানুভুতি দেখিয়েছেন এবং সাহায্য ও সহযোগিতা করে চলেছেন তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান এবং রোহিঙ্গাদের মানসম্মত পরিবেশে বসবাস নিশ্চিত করতে তাঁর সরকারের রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের উদ্যোগে সহযোগিতার জন্যও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার স্বপক্ষে তাঁর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জাতিসংঘ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তাঁর দৃঢ় সংকল্প তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা ফার্নান্দা এসপিনোসা গার্সেসকে ৪র্থ নারী হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩ তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানান এবং জাতিসংঘের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার সুরক্ষার যেকোন প্রচেষ্টায় অকুন্ঠ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
তিনি একইসঙ্গে বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেসকেও ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী ৭৩ তম সাধারণ অধিবেশনের প্রতিপাদ্য ‘মেকিং দ্যা ইউনাইটেড নেশন্স রিলেভেন্ট টু অল পিপল: গ্লোবাল লিডারশীপ এন্ড শেয়ারড রেসপন্সিবিলিটিজ ফর পিসফুল, ইক্যুইটেবল এন্ড সাসটেইনেবল সোসাইটিজ,’ উল্লেখ করে বলেন, সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের প্রতিপাদ্য আমাকে অতীতের কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতির পাতায় নিয়ে গেছে।
তিনি এ সময় ব্যক্তিগত স্মৃতি রোমন্থনে ৪৪ বছর আগে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর বাবা এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় প্রদত্ত ভাষণটি স্মরণ করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। এই শান্তির মধ্যে সারা বিশ্বের সকল নর-নারীর গভীর আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে রয়েছে। এই দুঃখদুর্দশা-সংঘাতপূর্ণ বিশ্বে জাতিসংঘ মানুষের ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্খার কেন্দ্রস্থল।’
তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত, অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।
‘কিন্তু, দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের জনগণের। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকেরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। একইসঙ্গে তারা আমার মা, তিন ভাই এবং পরিবারের অন্য সদস্য সহ ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়,’ -বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ভ্রাতৃপ্রতীম ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন আজও অব্যাহত রয়েছে যা আমাদের মর্মাহত করে। এ সমস্যার আশু নিষ্পত্তি প্রয়োজন। ওআইসি-র পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে আমরা ওআইসি-র মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে তিনটি মৌলিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তা হল – শান্তি, মানবতা ও উন্নয়ন। তাই মানব সমাজের কল্যাণে আমাদের মানবতার পক্ষে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ‘জনগণকে সেবা প্রদান এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। মানবতা ও সৌহার্দ্যই আমাদের টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
‘সমস্যা-সঙ্কুল এই পৃথিবীতে আমাদের সম্মিলিত স্বার্থ, সমন্বিত দায়িত্ব ও অংশীদারিত্বই মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে,’ – যোগ করেন তিনি।
চলবে/বাসস/এসএইচ-একেএইচ/এফএন/০৯৫৫/আরজি