মার্কিন ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশ নেয়ার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

4392

নিউ ইয়র্ক, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (বাসস): প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের পারস্পরিক স্বার্থে ব্যবসা, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন নিয়ে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে এই ব্যপারে সরকারের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সামনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আমি আপনাদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি উভয়ের পারস্পরিক স্বার্থে আপনাদের ব্যবসা, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন নিয়ে বাংলাদেশে আসুন। সোমবার যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার্স অব কমার্সের উদ্যোগে গ্রান্ড হায়াত হোটেলে অনুষ্ঠিত এক মধ্যাহ্ন ভোজন বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন।
‘অনুগ্রহ করে, আমাদের অংশীদারিত্বমূলক মুনাফা এবং উন্নয়নের যাত্রায় শরিক হোন। আমি এক্ষেত্রে আমার সরকারের পূর্ণ সাহায্য ও সহযোগিতার নিশ্চয়তা প্রদান করছি,’ -যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে সহজ বিনিয়োগ নীতি বিদ্যমান রয়েছে, যেখানে আকর্ষণীয় প্রণোদনা এবং সর্বোচ্চ মুনাফা লাভেরও সম্ভাবনা রয়েছে।
‘যার মধ্যে রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কে আইন দ্বারা সুরক্ষা প্রদান, কর অবকাশের মত প্রণোদনা, যন্ত্রপাতি আমদানীর ক্ষেত্রে স্বল্প শুল্ক, কাঁচামাল আমদানীতে আয়কর রেয়াত, টেমিট্যান্স অন রয়্যালটি, শতভাগ বৈদেশিক ইক্যুয়িটি এবং বিনা বাধায় লাভ এবং আসলসহ পুঁজি প্রত্যাবাসন সুবিধা’, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
অন্যান্য সুবিধার উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বেতন-ভাতায় তরুণ, নিবেদিত প্রাণ এবং সহজে প্রশিক্ষণযোগ্য জনশক্তি, ব্যবসা স্থাপনে স্বল্প ব্যয়, বৃহৎ শুল্ক ও কোটা মুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার, স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ ও পানির সুবিধা, বাংলাদেশের উন্নত ক্রেডিট রেটিংয়ের সুবিধা,স্বল্পতম ঝুঁকি এবং দ্রুত প্রযুক্তির আধুনিকায়ন সুবিধা।
বাংলাদেশের ভৌগলিক কৌশলগত অবস্থানের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগলিক কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশকে আঞ্চলিক যোগাযোগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বৈশ্বিক আউট সোর্সিয়ের উদীয়মান কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
তিনি বলেন, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমরা এগুলোকে সংযুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ৪শ’ কোটি মানুষের বাজারের একটি প্রবেশ দ্বার হতে পারে এবং দেশটির নিজেরও প্রায় ১৬ কোটি জনগণের একটি শক্তিশালী এবং ক্রমবর্ধনশীল বাজার রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা নেদারল্যান্ডের সরকারের সহযোগিতায় ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ গ্রহণ করেছি, যার লক্ষ্য হচ্ছে বন্যা এবং নদীর ভাঙ্গন রোধ করে পানির নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা টেকসই দু’অংকের প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য অবকাঠামো, যোগাযোগ এবং হাইটেক খাতকে বহুমুখীকরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।
তিনি বলেন, ‘থ্রাস্ট সেক্টর হিসেবে আমরা ব্যাংকিং এবং অর্থনৈতিক খাত, পর্যটন, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি।’
সমুদ্র অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নতুন শিল্প কারখানা এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছি, প্রায় দু’ডজন হাইটেক পার্ক ও প্রস্তুত রয়েছে।’
এ বছরের মার্চ মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে এলডিসি ভূক্ত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণের ঘোষণা দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ২০০৯ সাল থেকে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি যার লক্ষ্য বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তোরণকে প্রথম পদক্ষেপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর লক্ষ্য এখন ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ হিসেবে গড়ে তোলা।
‘বাংলাদেশ এখন আর সাহায্য নির্ভর দেশ নয়, আমাদের অর্থনীতি এখন আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও শ্রম বাজারের সাথে যুক্ত,’-বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের সাড়ে ৯ বছরের শাসনামলে দেশে গড়ে ৬ প্রতিবছর ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি গিয়ে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে পৌঁছায় এবং আগামী অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মূল্যস্কীতি ১২ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে নেমে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে এবং ২০১৮ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ অতীতের থেকে প্রায় ৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আর দারিদ্রের হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন সাধন করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বয়ং সম্পূর্র্ণতা অর্জনের পর বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৩য় শীর্ষ সবজি উৎপাদনকারী, ৪র্থ শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী এবং তৃতীয় শীর্ষ মিঠা পানির মৎস উৎপাদনকারী দেশ।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বর্তমার বিশ্বে দ্বিতীয় তৈরী পোষাক রপ্তানীকারক দেশ। এর রপ্তানীর পরিমাণ গত অর্থবছরে ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার এবং শিগগিরই বাংলাদেশ শীর্ষ রপ্তানীকারকের কাতারে উঠে আসবে বলে আশা করা যায়।
তিনি বলেন, সাহসী উদ্যোক্তা এবং বিদেশি বিনিয়োগে রপ্তানীর বহুমুখীকরণে তাঁর সরকারের পদেক্ষপ নতুন ক্ষেত্র তৈরীর পথকে সুগম করছে।
দেশের ঔষধ শিল্পের বিকাশের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের ঔষধ এখন অভ্যন্তরের ৯৮ ভাগ চাহিদা মিটিয়ে ১২৫টিরও বেশী দেশে রপ্তানী হচ্ছে।
তিনি বলেন, জাহাজ নির্মাণ শিল্প আরেকটি খাত যেখানে আমরা মধ্যম সারির সমুদ্রগামী জাহাজ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের রপ্তানী করছি। বিকাশমান তথ্য প্রযুক্তি খাতে দেশে এখন ১৩ কোটি ৬ লাখ মোবাইল সীম ব্যবহারকারী রয়েছে। প্রায় ৭ কোটি ৩ লাখ জনগণ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য এবং এই খাতটি বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগকে অবারিত করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে থাকা ৩২শ’ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা গত মাস নাগাদ ২০ হাজার মেগাওয়াটে এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় নির্মাণাধীন ২৪শ’ মেগাওয়াট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বৃত্তান্ত তুলে ধরে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে জানান। এরমধ্যে শতকরা ১০ ভাগ বিদ্যুৎ নবায়ণযোগ্য জ্বালানি থেকে আসবে বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি এটা জেনে অত্যন্ত খুশী যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের একক সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার, যার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমান ২০১৬-১৭ সাল নাগাদ ৭ দশমিক ৫ বিনিয়ন ডলার।
ইটারন্যাশনাল গভর্নমেন্ট রিলেশন্স-এর এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডিন্ট, মেট লাইফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এক্সিলারেট এনাজির্, স্টিফেন কোবোস, ইটারন্যাশনাল গভার্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এর ব্রায়ার্ন লোপে, বোয়িং, জেমস ও’ব্রায়েন, এলএনজি’র গ্লোবাল হেড, এওটি এনার্জি, কোকাকোলা’র বি পেরেজ, জিই পাওয়ার-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চিফ ডেভেলপমেন্ট অফিসার, ম্যাকলারী এসোসিয়েটস-এর রাষ্ট্রদূত ত্রেসিটা শেফার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নের ভূয়শী প্রশংসা করেন।
এছাড়াও, ইউএস-বাংলাদেশ গ্লোবাল চেম্বার্স অব কমার্স, কোকাকোলা বাংলাদেশ, অলব্রাইট স্টোনব্রিজ গ্রুপ, মোটোরোলা সলিউশন্স, এপিআর এনার্জি, ড্রিংকঅয়েল, আইবিএম, চিনারি, বাউয়ার গ্রুপ এশিয়া, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েটস ইন্টারন্যাশনাল, এক্সন মোবাইল, প্রাগমা সিষ্টেমস, শেভরন, ইউচিউব-গুগল, জিই পাওয়ার, ওয়ালমার্ট ম্যাকলার্টি এসোসিয়েটস, মেড্রোনিক, কোকাকোলা ইন্ডিয়া এন্ড সাউথওয়েস্ট এশিয়া-র জেষ্ঠ্য কর্মকর্তাবৃন্দ বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন।
বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন ইউএস চেস্বার অব কমার্সের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নিশা বিসওয়াল।
প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে একটি প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ গ্রহণ করে ইউএস চেমস্বার নেতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।