বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : শিশুদের সুষম খাবার প্রয়োজন

125

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
ব্যালেনস ফুড-চিলড্রেন
শিশুদের সুষম খাবার প্রয়োজন
ঢাকা, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : চৈত্রের প্রখর রোদ যেন দুষ্টুুমি করেই চোখেমুখে পড়ছিল ওর। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে সে। ওড়না দিয়ে কয়েকবার ঘাম মুছে নিল নিজের অজান্তেই। আবার কাজে মন দিল। ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজের পাশ দিয়ে বয়ে চলছে ব্রহ্মপুত্র নদ। তার পাশেই গড়ে উঠেছে ছোট্ট একটা পার্ক। সেখানে ফুচকা আর চটপটির দোকানে কাজ কওে ছোট্ট রোগাদুবলা এই মেয়েটি।
বয়স কত আর হবে! আনুমানিক ১২/১৩ বছর। নাম জিজ্ঞাসা করতেই মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় ‘সুমি’। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। বাবা রিক্সা চালিয়ে যা পান, তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই লেখাপড়ার পাট বন্ধ রাখতে হয়েছে। চটপটির দোকানে কাজ করে পাওয়া সামান্য কটা টাকা সন্ধ্যার পরে তুলে দেয় মায়ের হাতে। বড় ইচ্ছা ছিল, একদিন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় অফিসে চাকরি করবে। বাবা-মা আর ভাই-বোনদের মুখে হাসি ফোটাবে একদিন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর ডানা মেলতে পারেনি। রূঢ় বাস্তবতার কাছে হার মানতে হয়েছে। এখন মানিয়ে নিতে হয়েছে কাজের সাথে। সুমির অপুষ্ট শরীরে ক্লান্তির চিহ্ন বেশ স্পষ্ট।
এই যে অপুষ্টির দাপট, তার প্রধান কারণ হচ্ছে, অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, পুষ্টির গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। অধিক জনসংখ্যা যে দেশে, সেখানে পরিবেশ দূষিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। কারণ, অল্প জায়গায় অনেক লোকের বসবাসের ফলে নোংরা পানি, আবর্জনায় ভরপুর পথঘাট স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। এছাড়া অধিক জনসংখ্যার কারণে খাদ্যদ্রব্যের সহজলভ্যতাও কমে যায়। ফলে কিশোর-কিশোরীরা স্বাভাবিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। টাকাপয়সার টানাটানির কারণে প্রয়োজনীয় খাবার জোটে না। সেজন্যে অপুষ্টির শিকার হতে হয়। আবার যে পরিবারে অর্থের সমস্যা নেই, সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরাও অতিরিক্ত পরিমাণে জাঙ্কফুড খায়। ফলে তারাও অপুষ্টির শিকার হতে পারে। পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতাÑ যেমন বয়স অনুপাতে কতটুকু খাবার, কি খাবার, কত সময় পর পর খেতে হবে, তা অনেক মা-বাবাই জানেন না। রোজকার খাদ্যতালিকায় সুষম খাবারের ঘাটতি দেখা যায়। অপুষ্টি দূর করতে হলে সুষম খাবার খেতে হবে। এটা শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, সব বয়সের মানুষের জন্যই প্রযোজ্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপুষ্টির কারণে কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। রক্তস্বল্পতা, মুখের কোনায় ঘা, পেটের অসুখ, রক্ত আমাশয়, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ, চোখের অসুস্থতা, চুল পড়া, পেটে কৃমি, দুর্বলতা, শারীরিক গঠন সুষ্ঠু স্বাভাবিক না হওয়া ইত্যাদি সমস্যায় পড়বার আশঙ্কা প্রবল। এছাড়া অপুষ্টির কারণে কিশোর-কিশোরীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে হয় না। স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ পরিপূর্ণভাবে ঘটে না। বুদ্ধিগত বিকাশও বাধা পায়। ফলে বড় হলে সেই কিশোর বা কিশোরীর মধ্যে মেধার ঘাটতি থেকে যায়। এ কারণে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে।
অনেকেরই ধারণা, বেশি বেশি দুধ ও মাংস খেলেই বুঝি স্বাস্থ্য ভালো হয়। এ ধারণা ঠিক নয়। প্রতিটি মানুষেরই সুষম খাবার অর্থাৎ খাদ্যের সব কয়টি উপাদানের উপস্থিতি খাবারে থাকতে হবে, এমন সব খাবার খাওয়া উচিত। সে জন্য মাংস ও দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবারÑ মাছ, ডিম, ডাল, ভাত, রুটি, সবজি, ফলমুল সবই খেতে হবে। এ ছাড়া বিশেষ কোনো একটি খাবার বেশি বেশি খাওয়া ভালো নয়।
আমাদের দেশে বহু কিশোর-কিশোরী অপুষ্টির শিকার হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ এ্যান্ড সার্ভের (বিডিএইচএস) এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের ২৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। এই সমীক্ষায় কিশোরীর দৈহিক উচ্চতা ন্যূনতম ১৪৫ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই হার ১৩ শতাংশেরও কম। আবার কিশোরদের উচ্চতা ১৫০-১৫৫ সেন্টেমিটার হওয়া উচিত। কিন্তু সেখানেও অনেক কম। আবার বডি মাস ইনডেক্স (বিএমডি) অনুযায়ী ওজন ১৮ শতাংশ হতে হবে। সমীক্ষায় বলা হয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে ২৫ শতাংশ কিশোরীর ওজন ১৮ শতাংশের নিচে। জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রমের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৪৩ শতাংশ কিশোর-কিশোরী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, একজন অপুষ্ট কিশোরীর মাসিক ঋতুস্রাবের শুরুটা দেরিতে হতে পারে। আর এই রোগের প্রধান কারণ পুষ্টিহীনতা।
জন্মের সময় প্রতিটি শিশুর ওজন আড়াই কেজির বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিডিএইচএস-এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ২০১৬ সালে বাংলাদেশে কম ওজনের শিশু ছিল ৩৬ শতাংশ। দেখা গেছে, কিশোরী মায়েদের মাতৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকে না। এর ফলে তাদের গর্ভধারণ হলে শিশু অপুষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলে অনেকে মনে করেন।
সার্বিকভাবে দেশের কিশোর-কিশোরীদের অপুষ্টি দূর করতে ব্যাপক উদ্যোগ এখন থেকেই নেয়া দরকার। শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, উপযুক্ত সম্পূরক খাবার খাওয়ানো, ছয় মাস অন্তর অন্তর ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানোÑএই কার্যক্রম বাড়াতে হবে। শিশু বয়স থেকেই এটা করতে হবে। তাহলে শিশুদের অপুষ্টির কবল থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে। কিশোর বয়সে অপুষ্টির শিকার কম হবে। ভাতের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ ডাল, শাকসবজি, দেশী ফল খেতে হবে। এসবের চাষ বাড়াতে হবে। সমাজ থেকে অপুষ্টি দূরীকরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ সমাজের সকল স্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সুমিদের মতো এদেশের হাজারো শিশুকে অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/আই/হাহা/১৭১০/আহো/-ওজি