বাজিস-৭ : নাটোর জেলা কারাগারে কয়েদীদের কর্মযজ্ঞ

140

বাজিস-৭
নাটোর-কয়েদী
নাটোর জেলা কারাগারে কয়েদীদের কর্মযজ্ঞ
নাটোর, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : নাটোর জেলা কারাগারে সশ্রম দন্ডাদেশ প্রাপ্ত কয়েদীরা কর্মযজ্ঞে মেতেছেন। পড়াশুনা, খেলাধূলার পাশাপাশি কুটির শিল্প, সেলাই, বাগান করা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত হয়ে ব্যস্ত সময় অতিক্রম করছেন তারা। তাদের এই কর্মকান্ডে মনে হয় কারাগার আর শাস্তির ক্ষেত্র নয়, সংশোধনাগার।
শহরের বড় হরিশপুর এলাকায় নাটোর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে চালু করা হয়েছে বন্দী প্রশিক্ষণ, সংশোধন ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। কেন্দ্রে যুগপৎভাবে চলছে বাঁশ দিয়ে রকমারী পণ্য তৈরী আর সেলাই কার্যক্রম। রাজশাহী কারাগার থেকে বাঁশের রকমারী পণ্য তৈরীর কৌশল রপ্ত করেছিলেন যাবজ্জীবন দন্ড প্রাপ্ত শরিফুল ইসলাম ও হারুনর রশীদ। এই দু’জনের কাছে কাজ শিখে নিয়েছেন নাটোর জেলা কারাগারের অসংখ্য কয়েদী। বর্তমানে কাজ করছেন প্রায় ১৫ জন বলে জানালেন কেন্দ্রের ওয়ার্ডার ইকবাল। তাদের সুনিপুন হাতে তৈরী হচ্ছে বসার মোড়া, কলমদানী, বাঁশের বেড ঝাড়– আর ছনের ঝাড়–। জানা গেল, এই কর্মযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর গত ছয় মাসে এই কেন্দ্রে উৎপাদিত এক লক্ষ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ও কারা সপ্তাহ উপলক্ষে কারা ফটকের গেটে স্থাপিত স্টল থেকে।
কেন্দ্রের সেলাই কার্যক্রমও চলছে সমান গতিতে। জেলখানার দন্ডপ্রাপ্ত বন্দীরা সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করতে করতে এখন তাদের মধ্যে থেকে অনেকেই প্রশিক্ষক হয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে বন্দী সুজনের কাছ থেকে অন্যরা বেশী কাজ শিখেছেন, জানালেন ওয়ার্ডার ইকবাল। যেকোন সেলাই কাজই করতে পারছেন তাঁরা। নাটোর জেলা কারাগারে কর্মরত ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুই সেট করে ইউনিফর্ম তৈরী করে দিয়েছেন তারা। সমাজ সেবা বিভাগ থেকে দেওয়া ১৪টি সেলাই ও একটি ওভারলুপ মেশিনে কাজ চলছে। বাইরের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কম খরচে কারাগারের সেলাই কেন্দ্র থেকে পোশাক তৈরী করে নিতে পারবেন বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
কারাগার অভ্যন্তরের আঙ্গিনায় তৈরী হয়েছে ফুল,ফল আর সবজির বাগান। আঙ্গিনায় চাষ করা সবজি ডাটা প্রায় খাওয়ার উপযোগী পর্যায়ে। প্রস্তুতি চলছে শীত মৌসুমের সবজি চাষের। অর্ধশত আম, লিচু আর কাঁঠাল গাছ বন্দীদের মৌসুমী ফলের চাহিদা পূরণ করেছে ভালোভাবেই। বাগান তৈরী আর গাছের পরিচর্যায় বন্দীদের ভূমিকাই প্রধান।
কারা অভ্যন্তরে পরিচালিত হচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দুইটি গণশিক্ষা কেন্দ্র। সপ্তাহের পাঁচদিনে শতাধিক শিক্ষার্থী এই কেন্দ্রে পাঠ নিচ্ছেন। যে বন্দী একেবারে নিরক্ষর হয়ে কারাগারে এসেছিলেন, গণশিক্ষা কেন্দ্র থেকে লেখাপড়া ও হিসাব করা শিখে তিনি বের হচ্ছেন। কিছু না পারলেও অন্তত স্বাক্ষর করার সক্ষমতা তৈরী হচ্ছেই।
ধর্মীয় শিক্ষায় পিছিয়ে নেই এই কারাগারের বন্দীরা। প্রতিদিন ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। বিগত রমজান মাসে সম্মিলিতভাবে কারাবন্দীরা ৪২টি কোরআন খতম দিয়েছেন বলে জানালেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আর কারা অভ্যন্তরের আটার মিলে কাজ করছেন অনেক কয়েদী।
ক্যারাম,লুডু,দাবা, ব্যাডমিন্টন আর ভলিবলেও আগ্রহ অনেক বন্দীর। ওয়ার্ডগুলোতে রয়েছে টেলিভিশন। কারাগারের তিনজন বন্দী নিজেদের খরচে দৈনিক সংবাদপত্রও রাখছেন।
দন্ডাদেশ ভোগ করে সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন শহরের বড় হরিশপুর এলাকার সোহরাব কাজীর ছেলে আব্বাস কাজী। তিনি বলেন, কাজ করাতে কারাগারে সময় ভালো কেটেছে, শরীর ও মন ভালো ছিল। কারাগারে ধর্মীয় পড়াশুনা, স্যারদের কথাবার্তা আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। তাই আর কখনো অন্ধকারের পথে চলবো না, সামনের দিনে আমি আলোর পথের অভিযাত্রী- এমন দৃঢ প্রতিজ্ঞার কথা জানালেন সদ্য কারাগার থেকে বের হওয়া নাটোরের লালপুর উপজেলার উত্তর লালপুর এলাকার কামাল শেখের ছেলে মাহাবুবুল শেখ।
নাটোর জেলা কারাগারের জেল সুপার আব্দুল বারেক বলেন, কারাগারে কর্মরত সকল কর্মীরাই মানবতাবোধে উজ্জীবিত। সর্বোচ্চ মানবাধিকার সংরক্ষণ করে এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বন্দীদের উপর কোন নির্যাতন নেই। বরং কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে নিরন্তর প্রষ্টেটায় আমরা সর্বদা সক্রিয়। কারাগারের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বন্দীদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয়। এরফলে অনেকেই বন্দীদশা থেকে বের হয়ে সুপথে চলেন।
কারাগারে সশ্রম কারাদন্ডপ্রাপ্ত কয়েদীদের সময় ভালো কাটে, শরীর ও মন ভালো থাকে। তারা দন্ডাদেশের এক চতুর্থাংশ সময় রেয়াত পান বলে জানালেন ওই কারা কর্মকর্তা।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বাসসকে বলেন, কারাগারের বন্দী জীবনকে অন্ধকারে ঢেকে না দিয়ে পড়াশুনা, খেলাধূলা ও বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমের কাজে নিয়োজিত এবং উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে তাদের অপরাধ প্রবণ মানসিক অবন্থার পরিবর্তন ঘটাতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ লক্ষ্যে নিয়মিত পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
বাসস/সংবাদদাতা/১৬৩২/মরপা