প্রকৃতির ছোবলে উজাড় হচ্ছে টেংরাগিরি বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজি

226

বরগুনা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ (বাসস) : প্রকৃতির ছোবলে বরগুনার টেংরাগিরি বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। বিপন্নতার মধ্যে পড়ছে সেখানকার প্রাণীকুল।
বরগুনার তালতলী উপকূলীয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল নিদ্রাসকিনা, নিশানবাড়িয়া ও নলবুনিয়ার নিয়ে নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দয্যের লীলাভুমি টেংরাগিরি। ১৯২৭ সালের পূর্বে টেংরাগিরি সুন্দরবনেরই অংশ ছিল। ১৯২৭ সালের বন আইন অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তাান সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। পরে ১৯৬৭ সালে এটিকে টেংরাগিরি বনাঞ্চল হিসেবে নামকরণ করা হয়। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর এই বনে ৪০৪৮.৫৮ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত হয় টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।
বঙ্গোপসাগরে কোল ঘেঁষা এ বনাঞ্চলের তিন দিকে সাগর ও বান্দ্রা খাল, মেরজেআলীর খাল, সিলভারতলীর খাল, ফেচুয়ার খাল, গৌয়মতলার খাল, কেন্দুয়ার খাল, সুদিরের খাল, বগীর দোন খাল ও চরের খাল এ নয়টি ক্যালেন (খাল) বেষ্টিত এ বনাঞ্চল। প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের অপরূপ লীলাভুমি এ বনাঞ্চলের সাগর প্রান্তে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপরূপ ও মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়। সাগরপাড়ে সবুজের সমারোহ, বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও পাখির কলতান মুখরিত বনাঞ্চল। নানান সুরেলা কণ্ঠে এখানে উপভোগ করা যায় পাখপাখালির মিষ্টি কলকাকলি। গভীর অরণ্যের বুকচিরে এসব নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখে পড়বে সাগরের বিশালতা। বিভিন্ন গাছপালা সমৃদ্ধ কেওড়া, গরান, গেওড়া, ওডা, জাম, ধুন্দল, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই, তাল, কাঁকড়া, বনকাঁঠাল, রেইনট্রি, হেতাল ও তাম্বুলকাটা প্রভুতি শ্বাসমূলীয় গাছ হচ্ছে এ বনের প্রধান প্রাণ। সুন্দরবনের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন। এই সংরক্ষিত বনে প্রাণীকুলের মধ্যে কাঠবিড়ালি, বানর, শজারু, শূকর, কচ্ছপ, শিয়াল, ডোরাকাটা বাঘ, বনমোরগ, মধু কাঁকড়া, বন্যগরু, মহিষ ও প্রায় ৪০ প্রজাতির সাপ অন্যতম।
টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নলবুনিয়া, নিশানবাড়িয়া, আশারচর ও নিদ্রা-সখিনা এলাকায় দূর থেকে দেখতে অপরূপ ঘন বন মনে হলেও সাগর সংলগ্ন কয়েক কিলোমিটার এলাকার বনের গাছ স¤পূর্ণ উজাড় হয়ে গেছে। ঠেংরাগিরির দায়িত্বেরত সখিনা বিট কর্মকর্তা জাহিদ প্রামনিক বলেন, অতিরিক্ত জোয়ারে গাছের গোড়ায় বালু জমে গাছ মারা যাচ্ছে। টেংরাগিরি বনের গাছ মরে যাওয়ার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
বনাঞ্চলের দক্ষিণ সাগর সংলগ্ন চরে অসংখ্য বড় বড় রেইনট্রি, কেওড়া ও ছৈলা গাছ মরে পড়ে আছে। সাগরের প্রচন্ড ঢেউয়ের তোড়ে অসংখ্য গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শিকড়-বাকড় বের হয়ে গেছে। বালুতে এসব গাছের শ্বাসমূল ঢাকা পরায় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে গাছগুলোর পাতা ও কান্ড মরে যাচ্ছে। জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির পেয়ে বনাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ভূমির দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে।
জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে ও গাছের গোড়ায় বালু জমে গাছগুলো মারা যাচ্ছে বলে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোফরেস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. আলমগীর কবির জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে গ্রাষ্ম ও বর্ষাকালে অনিয়মিত বর্ষণ ও অতিবর্ষণ হচ্ছে। যার ফলে নদী সমুহের অববাহিকায় অধিকমাত্রায় ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। এতে নদীর পাড় এবং নদীর তলদেশে ক্ষয় ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে সাগর মোহনায় অধিকমাত্রায় পলি জমা হচ্ছে। যা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের উদ্ভিদের জীবন চক্রের স্বাভাবিক পর্যায়াবর্তনকে (সাকসেশন) সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত করছে। ফলশ্রুতিতে টেংরাগিরির মত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে কেওড়া, ছৈলা, বাইন ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বাগানের জীবন চক্র পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই একযোগে মরে যাচ্ছে। পানিবাহিত পলি জমে শ্বাসমূল ঢেকে যাওয়ার কারনেই মুলতঃ এ ঘটনা ঘটছে।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) অজিত কুমার রুদ্র জানান, শ্বাসমূলীয় বনের গঠনে তিনটি স্তর আছে। প্রথমত উপকূলে ভূমি গঠনের পর উড়িগাছ জন্মায়। দ্বিতীয়ত মাটি কিছুটা শক্ত হলে উড়িগাছ মরে গিয়ে কেওড়া, বাইন, গেওয়া ও ছইলা গাছ জন্মায়। তৃতীয়ত মাটি আরও শক্ত হলে আগের গাছগুলো মরে গিয়ে ওইখানে সুন্দরী, গড়ান, পশুর ও কাকড়াসহ অন্যান্য গাছ জন্মায়। শ্বাসমূলীয় গাছগুলো অভিযোজন পদ্ধতিতে শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করে। জোয়ারের পানিতে লবনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার গাছ মরে যাচ্ছে। শ্বাসমূলীয় গাছ ও টেংরাগিরি বনাঞ্চল রক্ষায় বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানো ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা টিম কাজ করছে।