হবিগঞ্জে পদ্মবিলের ফুল রক্ষায় প্রশাসনের উদ্যোগ গ্রহণ

913

হবিগঞ্জ, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ (বাসস) : পর্যটনের জন্য জেলায় আরেকটি নান্দনিক স্পট আবিস্কার হয়েছে। এই স্পটটি হল পদ্মবিল। হবিগঞ্জ শহরতলীতে হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে বর্ষাকালে এ বিলের অধিকাংশ জমিতেই প্রাকৃতিকভাবে পদ্মফুল জন্মে। ফলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে নান্দনিক দৃশ্য। বিলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গোলাপি আর সাদা রং এর পদ্ম দেখলে মন জুড়িয়ে যায় সবার। চোখ যত দূর যায় শুধু পদ্ম আর পদ্ম। পাপড়ি মেলে প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বাগত জানায় এ ফুলেরা। এমন অপরূপ দৃশ্য সবাইকে বিলটির প্রতি আকৃষ্ট করছে। কিন্তু ভ্রমণপিপাসুরা এই বিলের সৌন্দর্য উপভোগের চেয়ে ধ্বংসের দিকেই যেন মনোযোগ দিয়েছেন বেশী। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদীরা। তবে জেলা প্রশাসন পদ্মবিলের ফুল রক্ষায় নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে সবার মাঝে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হবিগঞ্জ জেলার হাওর এলাকায় বর্ষা ও শরৎ ঋতুতে শাপলাসহ বিভিন্ন জলজ ফুলে অন্যরতম সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। কিন্তু পদ্মফুলের তেমন একটা দেখা পাওয়া যায়নি। এ বছর হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার পুকড়া ইউনিয়নের মুড়াআব্দা গ্রামের পূর্বদিকে হাওরে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পদ্ম বিল থাকার কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পরে। এর পর ছাত্র,শিক্ষক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজন দলবেধে নৌকা নিয়ে যেতে থাকেন এই বিলে। শুধু ফুলের সৌন্দর্য দর্শন নয়। সকলেই ফুল ছিড়ে নিয়ে আসেন। কেউবা খোঁপায় বাধেন এই ফুল। ফেইসবুকে এই পদ্মবিল ভ্রমণ এবং ফুল ছিঁড়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। পদ্মবিলের সন্ধানে সবার মাঝে আনন্দ বিরাজ করলেও ফুল ছিঁঁড়ায় সকলেই হতাশা ব্যক্ত করেন।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসন যখন বিষয়টি জানতে পারে তখন জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক ফজলুল জাহিদ পাভেল, বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন খন্দকার বিভিন্ন সময় সরজমিনে স্পটটি পরিদর্শন করেন। পদ্মবিলের ফুল যাতে না ছেঁড়া হয় তার জন্য জরিমানার ব্যবস্থাসহ সংরক্ষনের উদ্যোগ গ্রহণ করে জেলা প্রশাসন।
পুকড়া ইউনিয়ন পরিষদ এর চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি নিজেও জানতেন না তার ইউনিয়নে এত সুন্দর একটি জায়গা রয়েছে। প্রশাসনের নির্দেশে তিনি সেখানে ফুল না ছেঁ^ড়ার জন্য সাইনবোর্ডের ব্যবস্থাসহ চৌকিদার নিয়োগের ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন। প্রশাসনের নির্দেশে এখন সেখানে যাওয়ার জন্য ফি আরোপ করা হবে।
তিনি আরও জানান, প্রতিদিন ৩০/৩৫টি নৌকায় করে শত শত পর্যটক ছুটে যান পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এতে করে নৌকা চালকদের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছে। হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জ সড়কে অবস্থিত বালিখাল থেকে নৌকা নিয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে যাওয়া যায় এই বিলে। ৩শ টাকার মত খরচ হয় সেখানে যেতে। প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে শুধুই পদ্ম ফুল আর পদ্ম ফুল। মাঝে মাঝে সাদা ও নীল শাপলা ফুলসহ রয়েছে অনেক জলজ উদ্ভিদ। পানকৌড়ি এবং বক পাখিও সেখানে দেখা যায় প্রচুর।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্য তোফাজ্জল সোহেল বলেন, পদ্মবিলের সন্ধান পাওয়ার কথা জেলে আমি যতটা না আনন্দিত তার ছেয়ে বেশী বিরক্ত এই ফুল ছিঁড়ায়। এটি অবশ্যই ভাল মানসিকতা নয়। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, বর্ষাকালে ৩/৪ মাস এখানে ফুল থাকবে। ওই সময় সহজই সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে এর সৌন্দর্য রক্ষা করা সম্ভব।
অঅজ শুক্রুবার সকালে পদ্মবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি নিজেদেও জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে সরকারী বৃন্দাবন কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একটি টিম পদ্মবিল পরিদর্শনে যায়। সেখানে গিয়ে তারা গাছ, ফল এবং ফুল নিয়ে আসে কলেজে সংরক্ষনের জন্য। কলেজের পুকুরে পদ্মফুল লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র আবু বক্কর এই বিল দেখে মুগ্ধ। তবে কেউ যাতে ফুল ছিঁড়ে না নেয় তার দাবী জানিয়ছে প্রশাসনের কাছে। একই দাবী তার সহপাঠী পলাশ সরকার,দীপংকার অধিকারী, তাছলিমা আক্তার, সৈয়দা মিছফাউল জান্নাত ও বর্ণালী দাশের।
পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, হবিগঞ্জের প্রকৃতি সারা দেশেই অনন্য। কিন্তু আমরা এই প্রকৃতির সৌন্দর্য তুলে ধরতে পারি না। উপরোন্ত আমরা পারলে ধ্বংস করি। পদ্মবিলের সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে হবিগঞ্জ পর্যটন সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা সম্ভব। কারণ এটি শহরের একেবারেই কাছে অবস্থিত।
সরকারী বৃন্দাবন কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সুভাষ চন্দ্র দেব জানান, পদ্মফুল দেখতে যেমন যেমন সুন্দর তেমনি এর অনেক গুণাগুন রয়েছে। পদ্মফুলের মধু চোখের অসুখের মহৌষধ। এর স্কন্ধ শ্বেতী ও হৃদ রোগের ঔষধ হিসাব ব্যবহার করা হয়। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে অনেক মিথলজি আছে এই পদ্মফুল নিয়ে। এই ফুল নিয়ে অনেক সাহিত্যও আছে। ভাল জায়গা ছাড়া এই ফুল হয় না বলে গোবরে পদ্মফুল প্রবাদ প্রচলিত।
তিনি ্আরও জানান, এই ফুল আমাদেরকে সংরক্ষণ করতে হবে। সিলেট এমসি কলেজ ও মৌলভীবাজার সরকারী কলেজের পুকুরে এই ফুল সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। হবিগঞ্জে এক সময় এই ফুলের আধিক্য ছিল। হবিগঞ্জে আবিস্কৃত পদ্ম বিল থেকে অবাধে ফুল ছিঁড়াকে তিনি দুঃখজনক বলে আখ্যা দেন।
তিনি বলেন, ইংরেজিতে শাপলাকে লিলি বললেও পদ্মকে লোটাস বলে। প্রাচীন কাল থেকেই পদ্মের সবকিছুই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাতা গ্রামের বাজারে জিনিসপত্র বাধার জন্য, কন্দ এবং ফুল ফল খাদ্য, সুগন্ধি, ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
বৈজ্ঞানিক নাম ঘবষঁসনড় হঁপরভবৎধ. পাতা গোল, মসৃন, শাপলার মত পাতার পরিধি খাজকাটা নয়। সাদা, লাল ও নীল তিন ধরনের দেখা যায়। শতদল, উৎপল, পংকজ, কমল, কুমুদ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এটি ভারতের জাতীয় ফুল। হিন্দু, বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতিক এটি। হিন্দু মিথলজিতে নারায়ণের নাভি থেকে সৃষ্ট পদ্ম লক্ষী দেবীর আসন। এছাড়া রামচন্দ্র ১০৮ টি নীল পদ্ম দিয়ে দেবী দূর্গাকে প্রসন্ন করেছিলেন।
সাহিত্যে পদ্ম পাতার জল কিংবা গোবরে পদ্ম ফুল আমরা শুনে থাকি। যোগাসনের একটি উল্লেখ্যোগ্য আসন হলো পদ্মাসন।
পদ্ম সৌন্দর্যের প্রতীক, পবিত্রতার, শ্রদ্ধার প্রতীক। বাংলা ভাষায় চরণকমল, করকমল, পাদপদ্ম ইত্যাদি শব্দ পদ্মকে ঘিরেই।
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক ফজলুল জাহিদ পাভেল বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য হবিগঞ্জ জেলার ব্রান্ডিং করা হয়েছে পর্যটন। পদ্মবিলের আবিস্কারের ফলে পর্যটন সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পাবে।
হবিগঞ্জর জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ জানান, পদ্মবিলের সন্ধান পাওয়ার খবর জানতে পেরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটি সংরক্ষণে বিশেষভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফুল ছিঁড়ে আনার বিষয়টি দুঃখজনক। ইউনিয়ন পরিষদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিষয়টি দেখভাল করার জন্য।