দারিদ্র্য বিমোচনে নারী

978

সিরাজগঞ্জ, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাড়াবিল গ্রামের বাসিন্দা আজাদ মিয়া। ভ্যান চালিয়ে কোনো মতে সংসার চালান। চার ছেলেমেয়েসহ মোট ছয়জনের সংসারে অভাব অনটন লেগেই আছে। অসুস্থতার কারণে আজাদ একদিন ভ্যান চালালে দুই দিন বিশ্রাম নিতে হয়। সংসারে অভাবের জন্য স্ত্রী আলেয়ার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হয়। সংসারে অভাব ঘুচাতে আলেয়া নিজেও ঝিয়ের কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। তারপরও সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে।
এ অবস্থায় একদিন বেসরকারি সংস্থার এক কর্মীর সাথে আলেয়ার পরিচয় হয়। তার কাছে সংসারের সব কথা খুলে বলে আলেয়া। ঘটনাটি ২০০৫ সালের। বেসরকারি সংস্থার ঐ কর্মী সমিতি থেকে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনের পরামর্শ দেন এবং আলেয়াকে ঋণ পেতে সাহায্য করেন। আলেয়া প্রথমে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনটি ছাগল ও চারটি মুরগি কিনে বাড়ির আঙিনায় পালন শুরু করেন। এক বছরের মধ্যে দুইটি ছাগল বাচ্চা দেয়। ছাগলের বাচ্চা ও মুরগির ডিম বিক্রি করে আলেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করেন। লেনদেন ভাল হওয়ায় ঐ সমিতি থেকে আবার আলেয়া ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এ ঋণের টাকা দিয়ে তিনি একটি গাভী কিনেন। গাভীটি প্রতিদিন তিন কেজি করে দুধ দেয়। গাভীর দুধ ও ডিম বিক্রি করে আলেয়ার সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসে ।
আলেয়া ২০১০ সালে সরকারি ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা কৃষি ঋণ নিয়ে বাড়ির পাশে একটি ছোট খামার গড়ে তোলেন। বর্তমানে তার খামারে ৫টি গাভী ও ১০টি ছাগল ২০টি মুরগি রয়েছে। আলেয়ার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে। লেখাপড়ার মাঝে তারা মায়ের কাজে সহযোগিতা করে। আলেয়ার স্বামী প্রতিদিন সকালে ভ্যানে করে গাভীর দুধ বাঘাবাড়ি মিল্কভিটায় পৌঁছে দেন। এখন আলেয়ার সংসারে আর অভাব নেই। আলেয়ার এ এগিয়ে যাওয়ার কাহিনী বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। উন্নয়নের নিরব বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ নারী সমাজ।
উন্নয়নশীল দেশের জন্য দারিদ্র মোকাবিলা করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ এ চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করে যাচ্ছে। দারিদ্রের হার অনেক কমে এসেছে। ইতোমধ্যে সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছে। এসব পরিকল্পনার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন। সরকারের বাস্তবায়িত উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে দরিদ্র যেমন হ্রাস পেয়েছে তেমনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করেছে তা দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে।
আমাদের দেশের নারীদের এক বিশাল অংশ আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত। দিন দিন তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্য উৎপাদন, গাভী পালন, মৎস চাষ, হাঁস-মুরগী পালন, সবজি বাগান, মৃৎশিল্প, বসতবাড়ির আশেপাশে বৃক্ষরোপন এবং বাঁশ ও বেতভিত্তিক শিল্পপণ্য ইত্যাদি কাজের সাথে নারীরা সরাসরি জড়িত। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের প্রায় ৩৪ শতাংশই নারী। শহর কেন্দ্রিক শ্রম নির্ভর শিল্পে বিশেষত পোশাক শিল্পের আশি শতাংশ কাজ নারীরাই করে থাকে।
দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসরত ও সামাজিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে বিশেষ করে হাওর ও চরাঞ্চলের নারীকে উৎপাদনশীল কাজে এবং অর্থনৈতিক মূলধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর ফলে নারীরা অর্থনৈতিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে আয়বর্ধক কাজে উৎসাহী হচ্ছেন। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও সম্পদের সমান অধিকারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সকল শ্রেণির বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। মৌলিক, সামাজিক, শিক্ষাগত এবং চিকিৎসাসেবা যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই পায় সেজন্য সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। মাত্র দশ টাকার মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক ব্যাংক হিসাব খুলতে পারছেন। সরকারি ব্যাংক থেকে আর্থিক ঋণ সহায়তার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত নারীরা এখন নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছে।
দারিদ্র্য মোকাবিলায় নারী শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার সাথে জাতীয় উন্নয়নের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটা আজ সুস্পষ্ট যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার ভূমিকা অনেক। একজন শিক্ষিত নারী শ্রমিক আর একজন অশিক্ষিত নারী শ্রমিকের মধ্যে পারিশ্রমিকের যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনি কাজের গুণগত মানেরও তফাৎ রয়েছে। তাই বেশি অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে নারীদের শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। এ বাস্তবতা অনুধাবন করে সরকার কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে।
দেশের ও সমাজের উন্নতির জন্য আলেয়াদের মত নারীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ইচ্ছা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সব নারীদের মধ্যে অব্যাহত থাকলে তারা আর পিছিয়ে থাকবে না। মনে রাখতে হবে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দারিদ্র্য মোকাবিলা সম্ভব নয়। সরকারের গৃহীত উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে নারীরা যাতে যুক্ত হতে পারে সে সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। গ্রামীণ নারীদের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে সরকার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে নারী সমাজকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই নারী সমাজ দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে পুরুষদের সাথে সমান তালে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।