বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও ‘অস্পষ্টতা’য় মা

337

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
প্রজনন-মা
প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও ‘অস্পষ্টতা’য় মা
॥ মাহবুব আলম ॥
ঢাকা, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : প্রতিটি দেশ তথা জাতির সুন্দর ভবিষ্যত অনেকটাই নির্ভর করে নতুন প্রজন্মের ওপর। অর্থাৎ একটা শিশুর জন্ম থেকে সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার ওপর। আর সুন্দর, সুস্থ একটা শিশুর জন্মগ্রহণ নির্ভর করে তার মায়ের ওপর। সুতরাং প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে মায়েদের সচেতন হতে হবে, সঠিক ধারণা থাকতে হবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে বাংলাদেশের অনেক নারীই সচেতন নন। প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও অস্পষ্টতায় বাংলাদেশের নারীরা। এ হাল-চাল শুধু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নয়, শহরেও। এক্ষেত্রে সচেতনতার পাশাপাশি মন-মানসিকতার পরিবর্তন ও মায়েদের প্রতি যতœশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, গর্ভধারণ কোনো অসুস্থতা নয়। অথচ প্রজননক্ষম বয়সে অর্থাৎ ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সে নারীদের যে মৃত্যু হচ্ছে, তার ১৩ শতাংশই ঘটছে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়। মায়েদের প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞার কারণেই এ মৃত্যু ঘটছে। কিন্তু মাতৃ মৃত্যুর কারণগুলো প্রতিরোধযোগ্য।
‘বাংলাদেশ মাতৃ মৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ ২০১৬ : প্রাথমিক প্রতিবেদন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে মাতৃ মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এর আগে ২০০১ ও ২০১০ সালেও মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ প্রকাশ করে। ২০০১ সালের জরিপে বলা হয়েছিল, ২০ শতাংশ নারীর মৃত্যুর কারণ ছিল মাতৃত্ব সংক্রান্ত।
২০১০ সালে তা কমে ১৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ছয় বছরের ব্যবধানে তা হয় ১৩ শতাংশ। ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীরা বেশি মারা যাচ্ছেন মাতৃত্বকালীন জটিলতায়। এর বাইরে ক্যানসারে ২৪ শতাংশ এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রজনিত কারণে ২৩ শতাংশ নারী মারা যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সরকারের করা ২০১৬ সালের জরিপে, বর্তমানে বাংলাদেশে মাতৃৃমৃত্যুর হার ১৯৬। অর্থাৎ এক লাখ জীবিত শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। গর্ভধারণজনিত জটিলতা, প্রসবকালে বা প্রসবের পর ৪২ দিনের মধ্যে কোনো প্রসূতির মৃত্যু হলে তাকে মাতৃমৃত্যু বলা হয়।
জরিপের প্রতিবেদন তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে সন্তান প্রসবের হার বেড়েছে। ২০০১ সালের মাতৃমৃত্যু জরিপে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের হার ছিল মাত্র ৯ শতাংশ, ২০১০ সালে তা হয় ২৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালের জরিপে তা হয়েছে ৪৭ শতাংশ। দেশে এখন পর্যন্ত ৫৩ শতাংশ মায়ের অদক্ষ প্রসব সহায়তাকারীর হাতে অনিরাপদ প্রসব হচ্ছে। সারা দেশে শুধু ৩ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ন্যূনতম মানদ- পূরণ করছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে মায়েদের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের অভাব বা অস্পষ্টতা।
২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী, প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ, খিঁচুনিতে ২০ শতাংশ, প্রসব জটিলতা বা দীর্ঘ সময় ধরে প্রসবের কারণে ৭ শতাংশ, গর্ভপাতের কারণে ১ শতাংশ, পরোক্ষ কারণ (হৃদরোগ, জন্ডিস ইত্যাদি) ৩৫ শতাংশ, সরাসরি অন্যান্য কারণ ৫ শতাংশ এবং অজানা কারণে ১ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয়।
২০১৬ সালের জরিপেও দেখা গেছে, রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ এবং খিঁচুনির কারণে ২৪ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। জরিপে গবেষক দলের সদস্য কামরুন নাহার বলেন, জরিপগুলোতে মাতৃমৃত্যুর কারণসহ যেসব জায়গায় গুরুত্ব দিতে হবে তা বলা আছে। মাতৃমৃত্যুর পেছনে বড় কারণ হিসেবে রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি প্রতিবারই চিহ্নিত হচ্ছে। কিন্তু এই দুটি কারণকে প্রতিরোধের জন্য যেভাবে কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কথা, তা দেখা যাচ্ছে না।
‘এছাড়া এ বিষয়ে সচেতনতা ও মায়েদের যতটুকু জ্ঞান থাকার কথা তাও জানতে পারছেন না কিংবা জানতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন না মায়েরা। এ বিষয়টিও দেখতে হবে।’
প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুন নাহার বলেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মায়েরা এখনও সচেতন না। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে তারা এখনও অস্বস্থিবোধ করেন।
‘সন্তান গর্ভে আসার আগে থেকেই জন্ম পরিকল্পনা করে সে অনুযায়ী অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিষয়টি খুব অবহেলিত। শিক্ষিত পরিবার তথা শহরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র বলছে, দৈনিক প্রায় ১৬ নারী বা প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ হাজার মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন, যার ৯৫ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য। তাই এই মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধীনে মিডওয়াইফারি এডুকেশন বিষয়ে কোর্স চালু রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার চিত্র তুলে ধরে এ প্রোগ্রামের প্রধান সেলিনা আমীন বলেন, মিডওয়াইফ সেবাকে গুরুত্বারোপের মাধ্যমে মায়ের মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য মাকে সহযোগিতা করা, কাউন্সেলিং করা এবং জটিলতা দেখা দিলে রেফারাল ব্যবস্থা করা।
বাসস-ইউনিসেফ ফিচার/মআ/স্বব/০৯১০/আহো/-ওজি