‘অপারেশান সার্চ লাইট’ খুলে দিল জাহান্নামের দরোজা : পাক মেজর

582

॥ আনিসুর রহমান ও সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন ॥
ঢাকা, ২৪ মার্চ, ২০২১ (বাসস): ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাত বিশ্ব ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়ে আছে। ওই রাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির ওপর আকস্মিক বর্বর ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়।
দু’জন সিনিয়র কমান্ডারসহ অন্তত তিনজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা এই বিষয়ে লিখেছেন, যার, একজন সেদিনের সেইসব ঘটনার খুবই প্রাণবন্ত বর্ণনা দেন।
মেজর সিদ্দিক সালিক তার বহুল আলোচিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে ওই দিনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘জাহান্নামের দরোজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল।’
তবে, অপর দুই সিনিয়র কমান্ডার প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত তাদের নিজ নিজ বইতে পাক বাহিনীর নৃংশসতার কথা দৃশ্যত গোপন করে ঘটনার বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতেন সালিক। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের কথা স্মরণ করে বলেন, ওই রাত ছিল অন্য যে কোন স্বাভাবিক মনোরম বসন্ত রাতে মতই।
তিনি লিখেছেন, সেদিনের সে ঢাকা শহর তারার আলোয় উদ্ভাসিত এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। বসন্তের রাত যতোটা হতে পারে ঠিক ততোটাই মনোরম ছিল ঢাকার সেই রাত। রাতটি গণহত্যা যজ্ঞ ছাড়া যে কোন কিছুর জন্যই উপযুক্ত ছিল।
সালিক জানান, ঢাকা ক্যান্টমেন্টে দুটি সদর দপ্তর স্থাপন এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে দায়িত্ব দিয়ে তাদের শীর্ষ কমান্ডাররা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’র নীল নকশা তৈরি করেন।
ঢাকা শহর ও এর আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয় রাও ফরমান আলীকে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাদবাকী অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জেনারেল রাজাকে।
সালিক লেখেন, লেফটেন্যাট জেনারেল টিক্কা খান ও তার স্টাফরা ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কর্মসূচির অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করতে সেকেন্ড ক্যাপিটালের মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারে সারা রাত কাটান।
তিনি লেখেন, জুনিয়র অফিসাররা মার্শাল ল এডমিনিস্টেটর্স হেডকোয়ার্টারে টিক্কা খানকে ঘিরে বসে ছিলেন। তারা লনে সোফা ও ইজিচেয়ার পেতে বসে এবং রাতভর জেগে কাটানোর জন্য চা ও কফির ব্যবস্থা করছিলেন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, টিক্কা খানের ‘আউটডোর অপারেশন্স রুম’এর বাইরে ওয়াল্যাস ফিট করা একটি জিপ রাখা হয়।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে প্রথমবারের মতো জিপে সেট করা ওয়াল্যাসটি শব্দ করে ওঠে।
সালিক বলেন, ঢাকার স্থানীয় কমান্ডার অগ্রসর হওয়ার অনুমতি চান। কারণ, অন্য পক্ষ অর্থাৎ বাঙালি প্রতিবাদকারীরা প্রতিরোধের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং তখন ঘটনাস্থলের সকলেই বারবার তাদের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তখনও কলম্বো ও করাচির মাঝপথে রয়েছেন। জেনারেল টিক্কা তখন সিদ্ধান্ত দিলেন ‘যতোটা সময় পারা যায় ববিকে (বিগেডিয়ার আরবাব) অপেক্ষা করতে বলো।’
সালিক বলেন, সৈন্যদের রাত একটা বাজার আগেই তাদের লক্ষ্যস্থলের মধ্যে পৌঁছাতে বলা হয়েছিল। তবে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ অপেক্ষা না করে রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা দেয়া শুরু করে।
তিনি বলেন, রেডিও, টেলিভিশন স্টেশন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও স্টেট ব্যাংকের নিরাপত্তা দিতে যে সকল সৈন্য শহরে ছিল তারা নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই তাদের অবস্থান নিয়েছিল।
সালিক বলেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়া প্রথম সারির সৈন্যরা ফার্মগেটে বাধার মুখে পড়ে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক কিলোমিটার দূরে ফার্মগেটে রাস্তার ওপর বিপুল সংখ্যক গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা হয়। পাশের ফাঁকা জায়গায় ভাঙা পুরনো গাড়ি ও নষ্ট স্ট্রিম রোলার ফেলে রাখা হয়।
তিনি উল্লেখ করেন, জেনারেল টিক্কা খানের সদর দপ্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্যারিকেড দেয়া নগীরর দিক থেকে কয়েকশ আওয়ামী লীগারের জয় বাংলা শ্লোগান তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম তাদের উৎফুল্ল শ্লোগান।
সালিক বলেন, সামরিক অস্ত্রগুলো তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং দৃশ্যত ১৫ মিনিটের মধ্যে শ্লোগানের ধ্বনি মিইয়ে আসে। সেনারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে
সালিক স্মরণ করেন, যখন প্রথম গুলি চালানো হয় ঠিক সেই মুহূর্তে সরকারি পাকিস্তান রেডিও’র কাছাকাছি দৈর্ঘের বেতার তরঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের অস্পষ্ট কন্ঠ শোনা যাচ্ছিল।’
বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড লোশাকের পরবর্তী সময়ের একটি লেখার প্রসঙ্গ টেনে সালিক লেখেন, ‘শুনে মনে হচ্ছিল এটি আগে থেকেই রেকর্ডকৃত বার্তা প্রচার করছে যেখানে শেখ (মুজিব) পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করছেন।
জেনারেল রাজা তার লেখা ‘এ স্ট্রেনজার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় সে দিনের সন্ধ্যার কথা স্মরণ করে বলেন, তিনি ও ফরমান আলী মুভি দেখতে গ্যারিসন সিনেমা হলে গিয়েছিলেন। সঙ্গে তাদের স্ত্রীরাও ছিলেন।
রাজা সিনেমা হলে স্বাভাবিক উপস্থিতিই প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু বিরতির সময়ে আলো জ্বালানোর পর তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন সকল বাঙালি সিনেমা হল অঙ্গন ত্যাগ করেছে।
তিনি উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্টের চলে যাওয়া ও এর প্রভাব এবং বর্তমান সংকট মোকাবেলায় আলোচনার ব্যর্থতা এসবের কোন কিছুই আর ব্যাপক ভাবে গোপন ছিল না।
তিনি বলেন, সৈন্যরা ব্যারাকে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বাভাবিক সৈন্যের চেয়ে আমরা পিটি৭৬ বাহিনী সক্রিয় করলাম।
রাজা উল্লেখ করেন, ঢাকার বাইরের অভিযান পরচিালনার দায়িত্বে থাকা আমার সদরদপ্তর পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। কিন্তু আমার জন্যে অপেক্ষা করা অত্যাচারের শামিল হয়ে পড়ে।
তিনি লেখেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবিত গ্রেফতারের দায়িত্বপ্রাপ্ত থ্রি কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের লেফেটেন্যান্ট কর্নেল জেডএ খান ও তার বাহিনী তাদের কাজ সম্পন্ন করার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল।
রাও ফরমান আলী তার ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ নামক বইতে উল্লেখ করেন, ‘অপারেশান সার্চ লাইট’ সাধারণ কোন সামরিক অভিযান ছিল না। যে কোন মারাত্মক দাঙ্গার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে কারফিউ জোরদারে বেসামরিক সরকারকে সহায়তাই এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল। এখানে পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণই ভিন্ন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, বিদ্রোহ দেখা দেয়ার প্রেক্ষিতে সরকারি কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
ফরমান আলী বলেন, তিনি ও রাজা অভিযান বাস্তবায়নে যদি কোন দূর্বলতা দেখান সেক্ষেত্রে দায়িত্ব ছিনিয়ে নিতে ইফতেখার জানজুয়া ও এও মিঠ্ঠা খানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ডেকে পাঠানো হয়।
সিদ্দিক সালিকও তার কথার প্রতিধ্বনি করে উল্লেখ করেন, কিছুদিন আগে জেনারেল ইয়াহিয়া মেজর জেনারেল ইফতেখার জানজুয়া ও মেজর জেনারেল এ ও মিঠ্ঠাকে ঢাকায় পাঠান। কারণ, খাদিম ও ফরমান যদি অভিযান চালাতে অস্বীকার করে তাহলে যেন এ দুজনকে দায়িত্ব দেয়া যায়।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ওয়ারলেস যোগাযোগে আড়িপাতার মাধ্যমে জানা যায়, পাকিস্তানের ওই রাতের অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল যতো বেশি সম্ভব ততো বেশি সংখ্যক বাঙালিকে হত্যা করা।
অপারেশ সার্চ লাইটের অখ্যাত একজন কমান্ডারকে সেই রাতে বলতে শোনা যায়, ‘আমি কেবলমাত্র একটি জিনিসেই বিশ্বাস করি।’